রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হিলারির সফরে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা



গেল সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এই সফর বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল। তার ওই সফর নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে, এ নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী মন্তব্য পর্যপ্ত করেছেন। মোটা দাগে তার বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে : ১. যুক্তরাষ্ট্র চায় সংঘাত এড়াতে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটি 'সংলাপ' হোক, ২. একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয়, ৩. বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত, ৪. চীন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে, ৫. গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকা-ে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়, ৬. হরতাল মার্কিন বিনিয়োগকারীদের 'ভুল' সিগন্যাল দিতে পারে, ৭. মিলিনিয়াম একাউন্টস থেকে সাহায্য পেতে হলে দুর্নীতি রোধ করতে হবে। এ ধরনের বক্তব্যে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা যে খুব একটা খুশি হননি, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকা-ে সরকার হস্তক্ষেপ করছে, এটা মানতে রাজি নন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। হিলারি ক্লিনটনের এ ধরনের মন্তব্যকে অর্থমন্ত্রী 'রাবিশ' বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তবে এটি সত্য, হিলারি ক্লিনটন যেসব মন্তব্য করেছেন, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল। কোনো বন্ধুরাষ্ট্রের 'প্রেসক্রিপশন' অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা যায় না এবং সেটি ঠিকও নয়। নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশ সফর প্রমাণ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের আগ্রহ বাড়ছে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, সেই 'শূন্যতা' পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালের মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গাড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে (গভীর সমুদ্রে)। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব ঘাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরকে আমি এসব বিষয়কে সামনে রেখেই বিশ্লেষণ করতে চাই।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ যে দিক তা হচ্ছে, একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি সাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধরোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। 'সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার' আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা, তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত মার্কিন স্ট্রাটেজিস্ট রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই_ আর তা হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সঙ্কুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্রাটেজিতে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে ্তুঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং্থ বা 'মুক্তার মালার' মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ্তুঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং্থ এর যে নেটওয়ার্ক, তাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ ও পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি-না ভারত মহাসাগরের সব নৌম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ ন্যাটিকাল মাইল। আর ইরান সীমান্তে রয়েছে মাত্র ৭১ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ওই গাওদার বন্দর দিয়েই গাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলঙ্কা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়ে আরো বেশ কটি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর বড় বিনিয়োগ রয়েছে এ দেশে। শেভরনের বিনিয়োগের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮২০০ কোটি টাকার সমান। শেভরন বর্তমানে জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে কাজ করছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত গ্যাসের শতকরা ৫০ ভাগ শেভরন একাই উৎপাদন করে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে তাদের কর্মকা-ে স্থানীয় জনগণ অসন্তুষ্ট। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। এখন অপর একটা কম্পানি চাইছে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তাদের অধিকার। বহুল আলোচিত 'টিফা' চুক্তির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ 'টিফা' নয়, বরং 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপরারেশন ফোরাম' (টিআইসিএফ) নামে ভিন্ন নামে চুক্তিটি করতে যাচ্ছে। এটি এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে চূড়ান্ত হয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। এ ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশ কোনো পাইরেটেড পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। ওষুধ শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে। এটা ঠিক, হিলারি ক্লিনটনের এই সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের প্রসঙ্গ উঠলেও 'গুম' তথা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' (এমসিসি) থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পাচ্ছে না_ এ প্রশ্নটিরও সমাধান হয়নি হিলারির সফরের সময়। মূলত দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালে এমসিসি গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক কোনো বিরোধ নেই। বরং শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রশংসা করে আসছে। হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসেও একই কথা বলছেন। সংলাপের যে কথা তিনি বলেছেন, তা নতুন নয়। ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তারা দুজন একটি নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছেন। বিএনপি এ ব্যাপারে সংসদে একটি প্রস্তাব রাখতে পারে। পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারেও হিলারি কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাননি। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য করে হিলারি ক্লিনটন যেমনি কোনো কোনো মহলে 'বিতর্কিত' হয়েছেন, আবার 'সংলাপ' এর আহ্বানে কেউ কেউ প্রশংসাও করেছেন। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হিলারি ক্লিনটনের ওই সফর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে। এটিকে এখন আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এখানেই নিহিত।
Daily Destiny
16.5.12

0 comments:

Post a Comment