রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য অরুচিকর

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন তাকে অসৌজন্যমূলক ও অরুচিকর বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেন, সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী ও সম্মানিত ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের রাগান্বিত ভাষায় তীর্যক মন্তব্য দেশবাসী আশা করে না। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন আমাদের অতিথি এবং ড. ইউনূস হচ্ছেন বিশ্বে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ও নোবল বিজয়ী। তাই তাদের প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, এমনিতেই বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে না। তার ওপর সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করায় পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করবে। সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন, সরকার এমন কোন পদক্ষেপ নেবে না, যাতে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিলারির এই বক্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায় বলে ড. ইউনূসের মন্তব্যকে রাবিশ বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাবেক বিচারপতি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তীব্র সমালোচনা করেছেন।

ড. আকবর আলি খান : এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান যুগান্তরকে বলেন, এটা অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব বক্তব্য। এরজন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী থাকবেন। এ বিষয়ে এর বেশি মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
এম হাফিজউদ্দীন খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দীন খান এ বিষয়ে বলেন, অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখন না বলে এখন এ ধরনের মন্তব্য করা মোটেও ঠিক নয়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল তাকে আদর-আপ্যায়ন করে এখন অপমান করা হচ্ছে। তার বক্তব্য পছন্দ হয়নি বলে তার ব্যাপারে বিষোদ্গার করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী রেগে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শোভা পায় না। ড. ইউনূসের বক্তব্যকে রাবিশ বলে ইউনূসকে অপমান করা হয়েছে। ড. ইউনূসকে যদি তার পছন্দ না হয়, তাহলেও অনেক ভালো ভালো শব্দ ব্যবহার করা যেত। তিনি রাবিশ বলে অর্থমন্ত্রীর পদকে খাটো করেছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে যে উদ্বেগের কথা বলেছেন তাতে মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এই মন্তব্য অপ্রত্যাশিত। গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনূস ঝগড়া করেছে। আমরা ঝগড়া করিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের একটি টাকাও দেশের বাইরের নয়, সব টাকা সরকারের। সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরকালীন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ড. ইউনূসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎ শেষে প্রফেসর ড. ইউনূস সাংবাদিকদের গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে তেমন কিছু না বললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন হলে তিনি এ ব্যাপারে তার উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করেন। অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে শুনেছি। এটা আমি আশা করিনি। কারণ আমি এ ব্যাংকের একজন প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামীণ ব্যাংকে সরকার কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। যে কারণে গ্রামীণ ব্যাংক এখনও সে অবস্থানে রয়েছে। সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায়, এই ধরনের মন্তব্য শুনে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, এটা ‘রাবিশ’। গ্রামীণ ব্যাংক আগে যে অবস্থায় ছিল এখনও সে অবস্থায় রয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূস দাবি করেন কিভাবে? একটি টাকাও তো তিনি দেননি। তবে হ্যাঁ, গ্রামীণের যে অন্য সংস্থাগুলো রয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখতে খুব শিগগির একটি কমিশন গঠন করা হবে।
দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসে রোববার এক অনুষ্ঠানে হিলারি ক্লিনটন বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে ইউনূসের পদ নিয়ে ‘বিরোধের’ বিষয়টি তিনি ওয়াশিংটন থেকে লক্ষ্য করেছেন। তিনি আশা করেন, সরকার এমন কিছু করবে না যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারির পারিবারিক বন্ধু হিসেবে পরিচিত। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণ দেখিয়ে গত বছরের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে ইউনূসকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউনূস এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে গেলেও উচ্চ আদালতের রায় তার বিপক্ষে যায়। ইউনূসের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার চাপ থাকলেও সরকার গত এক বছর ধরেই গ্রামীণ ব্যাংকে তাকে না ফেরানোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ব্যাংকের জন্য একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাবও চলতি বছরের শুরুতে খারিজ করে দিয়েছে সরকার।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে অসৌজন্যমূলক ও অরুচিকর বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোন ভদ্রলোক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের ব্যাচমেট ছিলেন। তিনি ভদ্রলোক বলেই আমরা জানতাম। কিন্তু ড. ইউনূস ও হিলারির ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। তিনি যে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তা হয়তো ভুলে গেছেন। এমাজ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, একজন বিদেশীর বক্তব্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে উক্তি করেছেন তা শুনে আমার বিশ্রি লেগেছে। অর্থমন্ত্রী যেটা বললেন, এটা বলা উচিত হয়নি। এমনিতেই বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হিলারির উদ্বেগের কারণ সম্পর্কে আগেই জানা দরকার ছিল এবং এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থাকা প্রয়োজন ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যকে রাবিশ বলা অসৌজন্যমূলক তো বটেই অরুচিকরও।
বিচারপতি সৈয়দ আমিনুল ইসলাম : হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশী অতিথিদের আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা শোভন নয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যকে অসৌজন্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন লেখক, কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, কারও কথার সমালোচনা যে কেউ করতেই পারেন। কিন্তু তা হওয়া উচিত কূটনৈতিক ভাষায়। হিলারি ও ড. ইউনূসের সমালোচনা করার সময় অর্থমন্ত্রীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল। তিনি ভদ্রোচিত ভাষায় সমালোচনা করতে পারতেন। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন আমাদের অতিথি। বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা, বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্তসহ অনেক কিছু তাদের কাছে চাওয়ার আছে। অন্যদিকে গ্রামীণ ব্যাংক ও হরতাল ইস্যুতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হিলারি ক্লিনটন এ ধরনের মন্তব্য না করলেই পারতেন। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ দুই রাজনৈতিক দলই করে দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় তাদের কাছেই ছুটে যান আমাদের রাজনীতিবিদরা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : হিলারি ক্লিনটন ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত বলে অভিহিত করেছেন সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য আমি টেলিভিশনে দেখেছি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু আমার কাছে নয়, অনেকের কাছেই অসৌজন্যমূলক লেগেছে বলে মনে হয়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। একজন সš§ানিত সিনিয়র মন্ত্রীর কাছে এটা আশা করা যায় না। কারও সমালোচনা যে কেউ করতেই পারেন, কিন্তু তা এমন ভাষায় হওয়া উচিত নয়। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউসূনকে নিয়ে একটি সমস্যা আছে এটা ঠিক। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান সরকার করতে পারত, কিন্তু করেনি। নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বিশ্বে একজন সš§ানিত ব্যক্তি, আমাদের গর্ব। সরকারের কাছ থেকে তার সেই সš§ান আশা করতেই পারি। ড. শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, যে দেশে গুণীজনরা সš§ান পায় না, সেই দেশে গুণীজন জš§ায় না। আর হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে বদিউল আলম জানান, আমরাই যুক্তরাষ্ট্রকে মোড়ল হিসেবে মান্য করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও সেটা মেনে চলে। কিন্তু আমরা নাগরিকরা বারবার বলেছি, অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বিরোধী দলকে সমঝোতায় বসতে হবে। নাগরিকরা দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতায় উৎসাহী। বিদেশী নয়, দেশের নাগরিকরা কি বলে সেটাই গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু তারা বিদেশীদেরই বেশি গুরুত্ব দেন এবং সমস্যা সমাধানে অতীতে তাদের ডেকে এনেছেন।

0 comments:

Post a Comment