অতি সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, পানিসম্পদমন্ত্রী প্রণব কুমার বানসালের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করেন। মনমোহন সিং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ভারত সরকার তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকলসহ গণচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। এমনকি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময়ও তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ভারত এমন কিছু করবে না যে, তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের একটা উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, এই টিপাইমুখ ও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। দুটো ক্ষেত্রেই এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে।
বারবার আমাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, অথচ নয়াদিলি্লতে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সেখানে পানি ধরে রেখে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ইতিমধ্যে সেখানে ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও হয়েছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিপাইমুখে বাঁধ হলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হবে। বাংলাদেশের এ আশঙ্কা ও উদ্বেগ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাতে করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারতকে বন্ধ রাখা যায়নি। দীপু মনির নয়াদিলি্ল সফরের সময় এবার কথা হল বাংলাদেশের একদল সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হবে টিপাইমুখে। এতে করে তো বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখা যাবে না? অতীতে আমাদের বেশ ক'জন সাংসদও গিয়েছিলেন টিপাইমুখে। তারা ফিরে এসে আমাদের জানান, তারা সেখানে কিছুই দেখতে পাননি। এখন সাংবাদিকরা গেলে সেখানে কী দেখতে পাবেন, আমরা তা জানি না।
আমাদের আরেকটা উদ্বেগের জায়গা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়া। গেল বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল; কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে সিকিমও একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিকিম ইতিমধ্যে তিস্তাকে ব্যবহার করে ২৭টি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এসব কারণে গজলডোবায় আগামীতে কতটুকু পানি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, একই নদীর ওপর এনএইচসিসির ২টি প্রকল্প রয়েছে_ ৩৩২ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে রয়েছে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
এ কারণে তিস্তায় যথেষ্ট পানি থাকার কথা নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর উত্তরবঙ্গ উন্নয়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। এর অংশ হিসেবে ২৫ বছর আগে তৈরি ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁহাতি খালে তিস্তা থেকে পানি নিয়ে এসে ছাড়া হয়েছে। এতে করে উপকৃত হয়েছে সেখানকার ১১ হাজার হেক্টর জমির সেচ কাজ। বাংলাদেশকে না জানিয়ে উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে কি-না, সেটা একটা বর প্রশ্ন হয়েই রইল। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে খোঁজ খবর করতে পারে।
২০০৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার 'জাতীয় প্রকল্প' হিসেবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের ৬টি জেলার ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০১৫ সালে। এই ব্যারাজ পুরোপুরিভাবে চালু হলে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি যে কমে যাবে, তা নয়, বরং ড্যাম সংলগ্ন এলাকায় ভূমি ধস বৃদ্ধি পাবে, নদীতে নুড়ি পাথরের প্রবাহ বাড়বে, বিপুল পলি বাংলাদেশ প্রবেশ করে বাংলাদেশের নদী ভরে ফেলবে। ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়বে। ইতিমধ্যে ভারত নিয়ন্ত্রিত গজলডোবা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তাসহ ছোট-বড় ১২টি নদী নাব্য হারিয়ে আবাদি জমিও খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে 'আমার দেশ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুমারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী।
ছাতনাই থেকে এ নদী ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট এরিয়ার প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ বা কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে_ এ রকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু'দেশের মাঝে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারাজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয় এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হঠকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ১৯৮৫ সালে ভারত তিস্তার উৎসমুখে গজলডোবা নামক স্থানে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করায় শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ সেচ প্রকল্পের উপকৃত এলাকা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। ইরিগেবল এরিয়ার (কৃষিযোগ্য ভূমি) ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর।
বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ উপজেলার শাহগিন্দি নামক স্থানে ২৪ কোটি ৮৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যায়ে দ্বিতীয় তিস্তা প্রকল্পের যে কাজ শুরু করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার ৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে অতিরিক্ত প্রায় ১৬.২১ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ৪৩ হাজার টন গম উৎপাদিত হবে। এর বাজার দর ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে; কিন্তু প্রধান নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে এখন পানি শূন্যতায় অসংখ্য চরের মরুদ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে (যুগান্তর) প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তিস্তা ব্যারাজে পানি প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।
একদিনের ব্যবধানে কমেছে ২ হাজার কিউসেক। ১৩ ফেব্রুয়ারি পানির পরিমাণ যেখানে ছিল ৪ হাজার কিউসেফ, পরের দিন তা কমে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার কিউসেকে। সেচনির্ভর বোরো আবাদে তিস্তার সেচ কমান্ড এলাকায় পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এভাবে পানি কমে গেলে বোরো আবাদ চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এই যখন পরিস্থিতি, তখন তিস্তার পানি ভাগাভাগিতে নতুন যে ফর্মুলার কথা শোনা যাচ্ছে; কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। তিস্তার উজানে পানির প্রবাহ আরো হ্রাস পাবে। ফলে আগামী দিনগুলোতে বোরো আবাদে নীলফামারী, দিনাজপুরও রংপুর জেলার ১৩ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৪৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে করে বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হতে পারে।
ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ মে বিবিসির বাংলা বিভাগ আমাদের জানায় যে, তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীপু মনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও বিষয়টি স্বীকার করে নেননি। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জট যে লেগেছে, তা-তো অস্বীকার করা যাবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মুহূর্তে শরিকদের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ মুহূর্তে মনমোহন সিংয়ের কাছে বাংলাদেশের চেয়ে মমতা ব্যানার্জির গুরুত্ব অনেক বেশি। জোট সরকারে কংগ্রেসের পরেই তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান। মমতাকে চটাতে চায় না কেন্দ্র। ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচন।
মমতাকে চটিয়ে আবার মমতাকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোটে ঠেলে দিতে চায় না কংগ্রেস। অতীতে তো মমতা বিজেপির সঙ্গেই ছিলেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আটকে যেতে পারে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। মমতা নিজেও তার জনপ্রিয়তা হারাবেন না। দীপু মনি নয়াদিলি্লতে একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তি না হলে, তা দু'দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মিথ্যা বলেননি দীপু মনি। ভারত বার বার আশ্বাস দেবে; কিন্তু সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেবে না, তা কাম্য নয়। আমরা অবশ্যই চাইব তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হোক এবং তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ থাকে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশেও নির্বাচন হবে। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি যে একটি ফ্যাক্টর হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই দু'দেশের সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টির সমাধান করতে হবে। শুধু ভারতীয় আশ্বাসে আমরা ভরসা রাখতে পারছি না
Daily DESTINY
23.5.12
0 comments:
Post a Comment