রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অলির বক্তব্য ও বিরোধীদলীয় রাজনীতির স্বরূপ


কর্নেল (অব.) অলি আহমদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন গত ১৫ মে। এইদিন এলডিপি আয়োজিত ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে জেলে থেকে খালেদা জিয়ার পক্ষে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব নয়। লন্ডন থেকে তারেক রহমানের পক্ষেও সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদেরই সেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং আমি সেই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’ বিএনপির নেতাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বিএনপিকে অনুরোধ করব আপনারা নেতৃত্ব দেন আর না হলে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন।’
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিএনপির জমানায় রেলমন্ত্রী ছিলেন। ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতা তিনি। স্পষ্টতই তিনি একটি ‘মেসেজ’ দিলেন। তিনি মেসেজটি দিলেন এমন এক সময় যখন বিএনপির ভেতরে বড় ধরনের ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’ রয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মূলত দলের ৫ জন সংসদ সদস্যের সংসদে যোগদানকে কেন্দ্র করে। খোদ তারেক রহমানের নির্দেশে তারা সংসদে যোগ দিলেও, দলের অনেক সিনিয়র নেতা এতে অসন্তুষ্ট এবং তারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। নিশ্চয়ই তারেক রহমান অনেক ‘হিসাব-নিকাশ’ করেই দলের নির্বাচিত এমপিদের সংসদে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ‘হিসাব-নিকাশ’ এর সঙ্গে বেগম জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়টি কতটুকু জড়িত, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও বাজারে এটা নিয়ে গুজব আছে।
এখন কর্নেল (অব.) অলি অনেকটা বিএনপির নেতৃত্ব নিজ কাঁধে নিতে চান। বিএনপি কত অসহায় হলে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে সুবিধা করতে পারেনি দলটি। কিন্তু তারপরও বিএনপিই বিরোধী দলের মূল কেন্দ্র। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হযেছিল (১৯৭৩ সালে প্রথম)। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের সংসদে বিএনপি পেয়েছিল ২০৭ আসন (শতকরা ৪১ দশমিক ১৭ ভাগ) (আওয়ামী লীগ-মালেক ৩৯ আসন, ২৪ দশমিক ৫৬ ভাগ ভোট)।
জিয়ার মৃত্যু, এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩ আসন, আর আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বয়কট করে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ওই নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৪০ আসন (৩০.৮১ ভাগ ভোট)। আর আওয়ামী লীগ পায় ৮৮ আসন (৩০.০৮ ভাগ ভোট)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে, যে সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১৩ দিন। ১৯৯৬ সালেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন (৩৭.৪৪ ভাগ ভোট), আর বিএনপি পেয়েছিল ১১৬ আসন (৩৩.৬১ ভাগ ভোট)। পরবর্তী সময়ে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০১), নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও (২০০৮) এই দুটি বড় দলের অবস্থান ছিল এরকম : বিএনপি তথা চারদলীয় জোট ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ) ও আওয়ামী লীগ ৬২ (৪০.১৩ ভাগ)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ২৬২ (আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন) (৫৬.৯ ভাগ ভোট), আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ৩৩ আসন (৩৮.০৬ ভাগ)। কিন্তু এর পর পরই দৃশ্যপট বদলে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যে নির্বাচন বিএনপি তথা চারদলীয় জোট বয়কট করেছিল।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নেয়। সংসদীয় রাজনীতির এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয় বড় দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কটা থাকা জরুরি। তাতে করে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই আস্থার সম্পর্ক আগামীতে কতটুকু গড়ে উঠবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন। জাতীয় নেতাদের প্রতি সম্মান দেখানো, কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য না করা, বিএনপিকে সংসদে কথা বলার সুযোগ দেওয়াÑ এ সবই নির্ভর করে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এখন উচ্চ আদালতের জামিন মঞ্জুর সাপেক্ষে এবং চিকিৎসকদের মতামত অনুযায়ী বেগম জিয়া যদি বিদেশে যান (?) তাহলে দলটি নেতৃত্বহীন অবস্থায় কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। বিএনপি আগেই অনেকটা নেতৃত্বহীন। দলটির স্থায়ী পরিষদের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তরুণ নেতৃত্ব বিএনপির ভেতরে জন্ম হচ্ছে না। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করারও কেউ নেই। তাই বিএনপির সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগদান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। এই যোগদান রাজনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন যদি ডেকে নাও আনে, বাস্তবতা হচ্ছে এই যোগদান ‘বিরোধী’ শিবিরে একটি বড় ‘সংকট’ তৈরি করেছে।
মৌমাছিরা যেমনি একটি রানী মৌমাছিকে কেন্দ্র করে একটি ‘চাক’ তৈরি করে, ঠিক তেমনি ছোট ছোট দলগুলো বিএনপিকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক চাক তৈরি করেছিল। ওই ছোট ছোট দলগুলোর অনেকগুলোরই কোনো গণভিত্তি নেই। সংগঠনের অস্তিত্বও নেই। একজন আন্দালিব রহমান পার্থ একাই ‘একটি দল’। দলটির নিবন্ধন আছে বটে, কিন্তু এর গণভিত্তি  কোথায়? কোন কোন জেলায় কটি সাংগঠনিক কমিটি আছে? ব্যক্তিপরিচয়ে কোনো দল কখনো টিকে থাকতে পারে না। রাজনৈতিক ‘কমিটমেন্ট’, তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ, সুস্পষ্ট রাজনীতি না থাকলে, যে কোনো দল ‘কাগুজে সংগঠন’ হিসেবে পরিচিতি পেতে বাধ্য। বিজেপি (পার্থর নেতৃত্বাধীন দল) এর ব্যতিক্রম নয়। বিজেপি এতদিন ‘বড় মর্যাদা’ পেয়েছে বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করার কারণেই। পারিবারিকভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার ছোট ভাইরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং পার্থর ‘ইউটার্ন’-এ আমি অবাক হইনি।
এখন ২০ দলীয় জোটে যে সব দল আছে, তাদের পক্ষে বিএনপিকে বাদ দিয়ে অন্য জোট গঠন করাও তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ফলে চূড়ান্ত বিচারে তারা বিএনপির নেতৃত্বেই আস্থাশীল
থাকবে। বিএনপির সাংসদদের শপথ নেওয়া ও সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনাকে ২০ দলীয় জোটের কেউ কেউ ‘আত্মহত্যা’ বললেও, আন্দালিব রহমান পার্থই এখন অব্দি একমাত্র ব্যক্তি, যে ও যার দল (বিজেপি) ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে। অন্যরা এখনো আছেন। তবে সময়ই বলে দেবে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন আসবে কি না।
এটা অস্বীকার করা যাবে না রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সংসদের মেয়াদ। বিএনপি তার ৫ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য আনতে পারবে না। ঐক্যফ্রন্টের আবেদনও ফুরিয়ে গেছে। ফলে আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো। সংসদের ভেতরে ও বাইরে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ আর থাকল না। সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধীদলীয় আসনে আছে। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। উপরন্তু এরশাদের অসুস্থতা, ভাই জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া জাতীয় পার্টির ভেতরে বড় ধরনের ‘সংকটের’ সৃষ্টি করেছে। রওশনপন্থিরা নাখোশ। এর প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টি যদি আগামীতে ভেঙে যায়, আমি অবাক হবো না। সব মিলিয়ে বিরোধীদলীয় রাজনীতি একরকম নেই বললে চলে। সংসদে ও সংসদের বাইরে বিরোধীদলীয় রাজনীতি চোখে পড়ে না। সরকারের এটাই প্লাস পয়েন্ট।
সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো সরকারের জন্যই কোনো ভালো খবর নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ‘ভুল’ করতে পারে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী এই ভুলটাই করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করেছিল। ওই সময় লোকসভার নির্বাচনে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৫২ আসন (৪৪ ভাগ ভোট)। এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেসকে অনেক একক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা জারি, সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাইয়ের মতো নেতাকে গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়েছিল। এর পরিণামে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল (আসন সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ১৫৪-এ)। সুতরাং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো বড় দলের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
বিএনপির সংসদে যোগদান নিঃসন্দেহে এই সংসদকে বড় গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছে। বিএনপি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে এটা আমাদের জন্য স্বস্তির খবর। এখন বিএনপিকে সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতিই করতে হবে। লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করা সহজ নয়, দলের জন্যও ভালো নয়। বিএনপিকে দল গোছাতে হবে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা জরুরি।
বয়স্ক নেতৃত্বকে উপদেষ্টাম-লীতে রাখা যেতে পারে, যেমনটি করেছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তিনি ‘নতুন মুখ’ এনেছেন। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি সিনিয়র অনেক নেতাকে ‘উপদেষ্টা পরিষদে’ পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাদের মন্ত্রীও করেননি। এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। সিনিয়ররা আজীবন ‘দল’ চালাবেন না। দলে নয়া নেতৃত্ব দরকার। বিএনপিকে এখন এই কাজটিই করতে হবে। এখন কর্নেল (অব.) অলি ২০ দলের মূল নেতৃত্বে আসতে চাচ্ছেন। তার একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু বিএনপি তার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটে থাকবে, এটা আমার মনে হয় না। আবার এটাও সত্য,  ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে গিয়েছিল। বিএনপির রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজি তাই অনেকের কাছেই একটি প্রশ্ন। রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। এক্ষেত্রে কর্নেল (অব.) অলির নেতৃত্বে যদি আরেকটি জোাটের ‘জন্ম’ হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
Daily Desh Rupantor
21.05.2019

0 comments:

Post a Comment