হলি আর্টিজান মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার পর সাজাপ্রাপ্ত দুজন জঙ্গি ইসলামিক স্টেটের লোগোসংবলিত টুপি পরে ও ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে ফটো সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের ‘কাহিনী’ এখন বড় ধরনের আলোচনার নাম দিয়েছে। স্পষ্টতই এটা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না এবং তারা যে সুপরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করেছে, তা বলার আর অপেক্ষাও রাখে না। দৈনিক দেশ রূপান্তরের ২৮ নভেম্বরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবিতে স্পষ্ট দেখা গেছে, আসামি রিগ্যানকে প্রিজনভ্যান থেকে গারদে নেওয়ার সময় মাথায় তার কোনো টুপি ছিল না। কিন্তু গারদ থেকে এজলাসে হাজিরের সময় ও রায় ঘোষণার পর তার মাথায় আইএসের লোগোসংবলিত টুপি দেখা যায়। একই সময় অপর আসামি রাজীব গান্ধীর মাথায়ও আইএসের টুপি ছিল। একজন ধর্মভীরু মুসলমানের মাথায় টুপি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই টুপিতে যদি আইএসের লোগো থাকে, তাহলে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার কাছেও একটি প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল টুপিগুলো তারা কোত্থেকে সংগ্রহ করল? এবং এই টুপি পরার উদ্দেশ্যই-বা কী? এটা নিয়ে গত কয়েক দিন একাধিক বক্তব্য আমি পত্রপত্রিকায় দেখেছি। অনেকের মন্তব্যও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নানাভাবে তারা এর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে বলতেই হবে, এটি কোনো সাধারণ ‘টুপি’ ছিল না। যেসব জঙ্গি ওই টুপি পরিধান করেছিল, তারা একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ কাজটি করেছে। প্রধানত তারা এই জঙ্গিবাদী আদর্শ থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পরও তাদের কর্মকাণ্ডে তারা এতটুকুও অনুতপ্ত নয়। বরং ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে তারা জানান দিতে চাইল, এই আদর্শকে ধারণ করে তারা কোনো অন্যায় করেনি। তাদের উপলব্ধিবোধে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মৃত্যু জেনেও তারা ‘ভি’ চিহ্ন দেখাল। হলি আর্টিজানের ঘটনায় ২২ জন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। তিন বছর পরও তাদের মনমানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসামিরা যখন আইএসের টুপি মাথায় পরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স’কে কোনো কোনো অপশক্তি নস্যাৎ করে দিতে চায় কি না? কেননা, ওই টুপি কোত্থেকে এলো? কারা সরবরাহ করল? কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে? একটি তদন্ত কমিটি ইতিমধেই্য গঠিত হয়েছে। কমিটি জেলখানা ও সেই সঙ্গে কোর্ট-কাচারির সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি যাচাই করে দেখতে পারে। জঙ্গি দমনে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সাফল্য আছে। কিন্তু এই একটি ছোট্ট ঘটনায় তাদের সব অর্জন যেন মøান হয়ে না যায়। মনে রাখতে হবে, এটি কোনো ছোট্ট ঘটনা নয়। এর একটি ইমপ্যাক্ট আছে। যে ‘শক্তি’ হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল, সেই শক্তিই এই ‘টুপি’ সরবরাহের পেছনে আছে। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তারা বিশ্বের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল, আজও আইএসের ‘টুপি’ দেখিয়ে একইভাবে তারা বিশ্বকে জানান দিল বাংলাদেশে এখনো জঙ্গি আছে! আমি এটাকে হালকাভাবে নিতে চাই না। সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, আইএসের কোনো টুপি নেই। কিন্তু টুপিতে যে লোগো ব্যবহার করা হয়েছে, তা আইএসের এটা তো অস্বীকার করা যাবে না? আইএস তাদের প্রচারকাজ চালানোর জন্য কিছু ‘সিম্বল’ ব্যবহার করে–যেমন কালো কাপড়, কালো পাঞ্জাবি, আরবি শব্দ ইত্যাদি। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের সময় যে ভিডিওবার্তা প্রচারিত হয়েছিল, তাতে এসব সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছিল। কল্যাণপুরের ঘটনায়ও আমরা তা দেখেছি। এমনকি শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের হত্যাকাণ্ডের সময়ও একই ধরনের সিম্বল আমরা দেখেছি। ফলে এ ধরনের সিম্বল ব্যবহার করে তারা যে কৌশলে তাদের প্রচারকার্য চালায়, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েও তারা কি কৌশলে আইএসের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে গেল? একদিকে বাংলাদেশ যখন জঙ্গিবিরোধী তার অবস্থাকে শক্তিশালী করেছে ও বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে, সেখানে কৌশলে তারা কি আইএসের নামকে ব্যবহার করল? যদিও তাদের এই ‘কৌশল’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেবে না। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বেড়েছে বৈ কমেনি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি কালো অধ্যায়। কিছু বিপথগামী তরুণ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল নিরীহ মানুষদের। তাদের এই হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই পরিকল্পনা করেছিল। এ জন্য তাদের আগে প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। তারা হলি আর্টিজান বেকারিকে বেছে নিয়েছিল একটাই কারণে আর তা হচ্ছে এখানে বিদেশিদের যাওয়া-আসা ছিল। এখানে বিদেশিরা নিয়মিত ডিনার করতে যেতেন। বিদেশিদের জিম্মি করে ও তাদের হত্যা করে তারা অন্তত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র নষ্ট করা। বাংলাদেশ যে একটি শান্তিও সম্প্রীতির দেশ, তা তারা নষ্ট করতে চেয়েছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে খুব সহজেই বিদেশি মিডিয়ায় স্থান পাওয়া যাবে, তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে, এ বিষয়টি তাদের বিবেচনায় ছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং বাংলাদেশে আসতে চাইবেন না। ফলে জঙ্গিরা সুবিধা পাবে। এই তরুণরা (মোবাশ্বের, খাইরুল, সোহান, নিবরাস ও শফিকুল) ছিল নব্য জেএমপির সদস্য। তাদের সংগঠিত করেছিল তামিম চৌধুরী। উদ্দেশ্য পরিষ্কার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ। হত্যাকাণ্ড তারা সংঘটিত করেছিল বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণা করেছিল। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ ঘৃণাভরে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পর তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিয়ে বাংলাদেশ জঙ্গিবিরোধী তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করল। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে আর বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। জঙ্গিবাদকে বিস্তার হতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিটিটিসিকে আমরা সেই কৃতিত্ব অবশ্য দেব। কিন্তু জঙ্গিবাদকে পরিপূর্ণভাবে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি এ ধরনের বক্তব্য আমরা দেব না। আমাদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই জঙ্গিরা সমাজে হয়তো বড় ধরনের ‘পেনেট্রেশন’ করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সমর্থনও করে না। কিন্তু ছোটখাটো দু-একটি ঘটনায় এটা প্রমাণিত এই মতবাদের সমর্থকরা সমাজে এখনো ঘাপটি মেরে আছে। তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্যের প্রাথমিক ধাপ যখন সম্পন্ন হয়েছে, তখন সংবাদপত্রে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আইএস নেতার মৃত্যুর পর আইএস জঙ্গিরা দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। সম্প্রতি ব্যাংককে শেষ হওয়া আসিয়ান মন্ত্রীদের বৈঠকে তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। অনেকেই মনে করেন, আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর মতাদর্শের মূলোৎপাটন করতে দীর্ঘ লড়াই করতে হবে। তারা মনে করেন, আইএস জঙ্গিদের ফেরত আসা, অনলাইনে উগ্রবাদ ঠেকাতে ও সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাগদাদির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি যে রাজনীতির বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, তা রয়ে গেছে। সেখান থেকে ‘হত্যার রাজনীতি’ আবার শুরু হতে পারে! দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইনে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও আইএসপন্থি জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কার মতো একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশেও আইএস তাদের থাবা বিস্তার করেছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা অতটা উদ্বিগ্ন নই। কেননা, নব্য জেএমবি, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল, তাদের কর্মকাণ্ড এক রকম নেই বললেই চলে। তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা আর নতুন করে সংগঠিত হতে পারছে না। কিন্তু জঙ্গিবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কতগুলো বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যেসব জঙ্গি বাংলাদেশ থেকে সিরিয়ায় ‘যুদ্ধ’ করতে গিয়েছিল, তাদের কোনো পরিসংখ্যান হয়তো আমাদের কাছে নেই। কিন্তু ওইসব অঞ্চল থেকে কারা ফেরত আসছেন, তারা কোথায় থাকছেন, কী করছেন, এ ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো দরকার। গ্রামগঞ্জে মসজিদ, মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো দরকার। জঙ্গিরা এই মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকে টার্গেট করে তাদের অপতৎপরতা বাড়াতে পারে। অনলাইনে কী ধরনের বক্তব্য যায়, সেখানে জঙ্গি মতাদর্শের পক্ষে কোনো বক্তব্য থাকে কি-না তা নিয়মিত মনিটর করা প্রয়োজন। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম এবং এই ধর্ম যে উগ্রবাদকে সমর্থন করে না এ ব্যাপারে দীর্ঘস্থায়ী প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই কাজটি করতে পারে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে কিছুটা শ্লথগতি এসেছে বলে মনে হয়। গ্রামগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। এসব ওয়াজ মাহফিলে উগ্রবাদী রাজনীতি ছড়ানো হয় বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং নিয়মিত ওয়াজ মাহফিল মনিটর করা প্রয়োজন।
জঙ্গিবিরোধী অবস্থানের একটা অধ্যায় পার হলো। এখন বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছিল। এখন দোষীদের বিচার সম্পন্ন করে কিছুটা হলেও বাংলাদেশ তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারল। কিন্তু যেতে হবে আরও কিছুদূর। সমাজে বিভ্রান্তকারীরা এখনো আছে। তারা ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে ‘ব্যবহার’ করতে চায়। টুপিতে আইএসের লোগো ব্যবহার কোনো বড় ঘটনা নয়। কিন্তু ওই জঙ্গিরা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য যে আদৌ অনুশোচনায় ভোগে না এটাই চিন্তার কারণ। তারা এখনো তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আমাদের চিন্তার কারণ এখানেই।
Desh Rupantor
01.12.2019
0 comments:
Post a Comment