রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ট্রাম্পের অসুস্থতা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও কিছু কথা

তিনি বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, করোনা ভাইরাস বলে কিছু নেই। এটা চীনা ভাইরাস। সর্বশেষ জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ পরিষদের ভার্চুয়াল বৈঠকেও তিনি চীনের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখলেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ যখন সারাবিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ অতিক্রম করেছে, তখন অত্যন্ত অবজ্ঞাভরে তিনি এই ভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এটা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো সিরিয়াস পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। তাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল সব সময় মুখে মাস্ক পরিধান করে থাকার জন্য। তিনি মুখে মাস্ক পরতেন না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজেজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর প্রটোকল অনুযায়ী মুখে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক। তাকে জনসমাবেশ এড়িয়ে চলতে বলা হলেও তা তিনি মানতেন না। তার একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা প্রথমে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন, যার সঙ্গে গত এক সপ্তাহ তিনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্ব দেননি যে, তার ওই উপদেষ্টার মাধ্যমে করোনা ভাইরাসটি ছড়াতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তাই হলো। তিনি ও তার চেয়ে বয়সে ২৪ বছরের ছোট তৃতীয় স্ত্রী ম্যালেনিয়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। advertisement ট্রাম্প একজন বয়স্ক মানুষ। বয়স তার ৭৪। শরীরের ওজন বেশি, ২৪৪ পাউন্ড, ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা এবং মোটা। সাধারণত এ বয়সের মানুষরাই করোনা ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হন। তার কোলেস্টেরল (এলডিএল ১৬৭) বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া যখন তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। ৩ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন। শুক্রবার ডাক্তারদের পরামর্শে ভর্তি হয়েছেন মেরিল্যান্ডের ওয়ালটার রিড মেডিক্যাল সেন্টারে। তিনদিন তার হাসপাতালে থাকার কথা কিন্তু মাত্র দুই দিন থেকে তিনি ফিরে গেছেন হোয়াট হাউজে। নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিন কোয়ারেনটিনে থাকার কথা এখন তিনি থাকবেন কিনা সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। ওই বিতর্ক দেশজুড়ে বড় বিতর্কের জন্ম দেয়। ট্রাম্প সমালোচিত হন তার আচরণ ও অশোভন বক্তব্যের জন্য। দ্রুতই তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন এখন অনেক পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ১৫ অক্টোবর মিয়ামিতে, আর তৃতীয় বিতর্ক ২২ অক্টোবর নাসভিলে। ট্রাম্পের অসুস্থতার কারণে তিনি দ্বিতীয় বিতর্কে অংশ নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা, আর ‘সব বিষয়কে হালকাভাবে দেখার’ যে মানসিকতা ট্রাম্প পোষণ করেন, তার পরিণতি আজ তিনি নিজে ভোগ করছেন। যদিও হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয়েছে, তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন। তবে তিনি কতটুকু সুস্থ হবেন কিংবা তিনি কতটুকু কর্মক্ষম থাকবেন, এ প্রশ্নটা উঠেছে। তার অসুস্থতা কয়েকটি বিষয়কে জোরালো করল। এক. কোভিড-১৯ যে একটি সিরিয়াস স্বাস্থ্য ইস্যু, তা অস্বীকার করা যাবে না। দুই. ট্রাম্পের অসুস্থতা তার জন্য ‘প্লাস’ পয়েন্ট হতে পারে আবার ‘মাইনাস’ পয়েন্টও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রেসিডেন্টের জন্য যে সুস্থতা দরকার, তা তার না থাকায় ভোটাররা তাকে ভোট নাও দিতে পারে। তিন. ট্রাম্প এখন আর কোনো প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। এতে করে বাইডেনও বাধ্য হবেন নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করতে। চার. ট্রাম্প ‘ফান্ড রাইজিং’-এর জন্য এখন আর কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারবেন না। পাঁচ. ট্রাম্পের অসুস্থতা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা। ছয়. তিনি যদি অকর্মণ্য হয়ে পড়েন তা হলে একটা বড় সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের আগেই কতগুলো ‘ইস্যু’ সামনে চলে এসেছিল, যা বিতর্কের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী পরিমাণ ট্যাক্স দেন। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ধনীদের একজন ট্রাম্প। প্রথম কাতারে না থাকলেও ২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, ট্রাম্পের সম্পদের পরিমাণ ৩.১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এই হিসাব। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তার সম্পদ আরও বেড়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের কাতারে তার অবস্থান ২৫৯তম, আর বিশ্বে ৭১৫তম। তবে ২০১৫ সালে ট্রাম্প এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্বীকার করেছিলেন, তার সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার (এনবিসি, ১৬ জুলাই ২০১৫)। যে পরিমাণ অর্থই তার থাকুক না কেন, তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর (২০১৬) তিনি স্বীকার করেননি কখনো। তার ট্যাক্স ফাইলে তা উল্লেখও করেননি। তবে তার ট্যাক্স ফাইলের গোপন তথ্যটি ফাঁস করে দেয় নিউইয়র্ক টাইমস গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের দুই দিন আগে। তাতে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সবাইকে অবাক করেছে। তিনি একজন বিলিওনিয়ার, কিন্তু ট্যাস্ক দিয়েছেন মাত্র ৭৫০ ডলার (২০১৭ সালের হিসাব)! অন্যদিকে আরেকটি তথ্যও আমরা পেয়েছি। তাতে দেখা যায়, অন্যতম প্রার্থী জো বাইডেন ট্যাস্ক দিয়েছেন ৩৭৪২৯৭৪ ডলার, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও জো বাইডেনের রানিংমেট কমলা হারিস দিয়েছেন ৫১৬৪৬৯ ডলার, সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ৩৪৩৮৮২ ডলার, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন দিয়েছেন ২৬৮৪৮৪ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হয়, যারা চাকরি করেন। আয় থেকেই তারা ট্যাক্স দেন। তা হলে ট্রাম্পের ব্যাপারে এত ফাঁকিঝুঁকি কেন? সাধারণত ধনী ব্যবসায়ীরা এ কাজটি করেন- তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেন। ট্রাম্পও দিয়েছেন। তবে অত্যন্ত কৌশলে এই কাজটি তিনি করেছেন। অতীতে একাধিকবার এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও ট্রাম্প কখনই তা খোলাসা করেননি। এবারও যখন নিউইয়র্ক টাইমস তথ্যটি ফাঁস করে দিল, হোয়াইট হাউস কিংবা ট্রাম্পের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে তা খ-ন করা হয়নি। পাঠকদের জানার জন্য আরও কিছু তথ্য দিই। গড়পড়তা একজন শিক্ষক (স্কুল) সেখানে ট্যাক্স দেন ৭২৩৯ ডলার (বছরে), একজন দমকলকর্মী দেন ৫২৮৩ ডলার, একজন নার্স দেন ১০২১৬ ডলার, একজন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার দেন ১৬৪৪৭ ডলার (প্রোগেস রিপোর্ট, ৩০ সেপ্টেম্বর)। আর ট্রাম্প দেন মাত্র ৭৫০ ডলার! তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে বছরে যে বেতন পান (৪ লাখ ডলার), তা তিনি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন। একজন প্রেসিডেন্ট যখন অবসরে যান, আজীবন তিনি পেনশন পান, যার পরিমাণ ২১৯২০০ ডলারের মতো বছরে। advertisement একজন ধনী ব্যক্তি হয়েও ট্রাম্প ট্যাক্স দেন না, এটা বহুল আলোচিত এবং প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কেও তাকে এ প্রশ্নটি করা হয়েছিল। তখন জবাবে বলেছিলেন, তিনি ‘মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স’ দেন! তা হলে কি তিনি মিথ্যা বললেন? তার স্টাফরা অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারেননি। তার অর্থ হচ্ছে, তিনি যা বলেছেন, তা মিথ্যা। তার বক্তব্যের সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তথ্যের কোনো মিল নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এখানেই। একজন প্রেসিডেন্ট কি তা হলে মিথ্যা বললেন? তার সুস্থতা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তার ‘কর্মদক্ষতা’ এখন প্রশ্নের মুখে। যদিও হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন। পরিস্থিতি কি ১৯১৯ সালের মতো হতে যাচ্ছে? ১৯১৮-১৯১৯ সালের মহামারীতে (ইনফ্লুয়েঞ্জা) তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন আক্রান্ত হন। তিনি প্যারালাইজড ও অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু বিষয়টি গোপন রাখা হয় (নিউইয়র্ক টাইমস ২, অক্টোবর ২০২০)। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট অসুস্থ, অকর্মণ্য হলে তাকে অপসারণ করার বিধান আছে। অনেক ক্ষেত্রে এটা ‘জোর’ করে, অথবা তিনি যদি উত্তরাধিকারীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না চান, সে ক্ষেত্রেও তাকে অপসারণ করা যায়। ট্রাম্পের পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে? এজন্য আগামী কয়েকটি দিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Amader Somoy 6.10.2020

0 comments:

Post a Comment