রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিতর্ক ও নাটকীয়তা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক ও নাটকীয়তা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। ৩ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন। ৫০টি রাজ্যের নির্বাচকমন্ডলীর ভোটে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচনের বাকি আছে যখন মাত্র কয়েক সপ্তাহ, তখন একের পর এক ‘নাটক’-এর অভিনয় হচ্ছে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে। প্রথমে ট্রাম্প কর্তৃক বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি পদে মনোনয়ন। কনজারভেটিভ ও রিপাবলিকান মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যারেটকে ট্রাম্প কর্তৃক মনোনয়ন দেওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নির্বাচন নিয়ে ‘প্রশ্ন’ দেখা দিলে, তা সুপ্রিম কোর্টে যাবে এবং সুপ্রিম কোর্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ‘রায়’ তার পক্ষে যাবে। দ্বিতীয়ত, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেননি। তিনি দাবি করেছেন তিনিই জিতবেন। তৃতীয়ত, ডাকযোগে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। তিনি অর্থাৎ ট্রাম্প তার শংকার কথা জানিয়েছেন যে ডাকযোগে ভোটে জালিয়াতি হতে পারে। অথচ নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডাকযোগে দেওয়া ভেটে জালিয়াতির সম্ভাবনা কম। চতুর্থত, তিনি জানিয়েছিলেন রাশিয়ান হ্যাকাররা সক্রিয়। তারা নির্বাচনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। অথচ কোনো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এ ধরনের আশংকার কথা বলা হয়নি। পঞ্চমত, তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন চীন তার বিরোধিতা করছে, যাতে তিনি পুনর্নির্বাচিত হতে না পারেন। ষষ্ঠত, তার ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি এখন নিউ ইয়র্ক টাইমস ফাঁস করে দিয়েছে। অথচ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, তিনি মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স দেন। এখন এটা প্রমাণিত যে, তিনি জাতিকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। সপ্তমত, নাটকীয়ভাবে গেল শুক্রবার তিনি টুইট করে সারা বিশ^কে জানালেন তিনি ও তর স্ত্রী মেলানিয়া কভিড-১৯-এ আক্রান্ত। তিনি ও তার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো তাকে এক ঘণ্টা অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। দুদিন হাসপাতালে থেকে তিনি আবার হোয়াইট হাউজে ফিরে গেলেন। বললেন, ‘তিনি ভালো আছেন। ’ একের পর এক এমন নাটকীয় ঘটনা ঘটছে এমন এক সময় যখন তার জনপ্রিয়তায় ধস নামছে। ট্রাম্পের জন্য আরেকটা খারাপ খবর হচ্ছে তার আমলে উগ্র শে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠীর উত্থান ও জাতিগত বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়া। তার আমলে কৃষ্ণাঙ্গরা যেভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে, তার রেশ ধরে জন্ম হয়েছে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ আন্দোলনের। ট্রাম্পের উসকানিতেই জন্ম হয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী Proud Boys। প্রথম টিভি বিতর্কে ট্রাম্প এদের কর্মকান্ডে সমর্থন করায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে একটা অনাস্থার জায়গা তৈরি করলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। ফলে সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পুনঃপুনঃ ঘূর্ণিঝড়। অথচ ট্রাম্প এটা বিশ্বাস করেন না। তাই তার পুনর্নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং বিশ্ববাসীর জন্যও হবে একটা খারাপ খবর। কভিড-১৯ নিয়েও তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। তিনি মাস্ক পর্যন্ত ব্যবহার করেন না। নিজের মতো করে চলেন। কভিড-১৯-এর ব্যাপারেও তিনি একা সিদ্ধান্ত নেন। টিভি বিতর্কে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, তিনি রোগ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছেন এবং তিনি না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ লাখ মানুষ মারা যেত! অথচ পরিসংখ্যান বলছে কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২১৪৬২৬ জন (Worldometer)। পাঠকদের জানিয়ে রাখি ট্রাম্পের শাসনামলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এমনকি সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর টিকা সরবরাহের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ট্রাম্প এই প্রক্রিয়ায় থাকবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এর আগে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস চুক্তি, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি, ইউনেসকো, ইরান পারমাণবিক চুক্তি, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকেও যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র একা চলতে চাইছে। ট্রাম্পের জমানায় এই ধারণা আরও শক্তিশালী হবে; যদি তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হন। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট। ৫০টি স্টেটের মাঝে কোনো কোনো স্টেটে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা বেশি। কোনোটাতে আবার কম। জরিপে জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও সব জরিপের ফলাফলই যে শেষ পর্যন্ত ‘সত্য’ হয়, তা বলা যাবে না। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জনমত জরিপ শেষ পর্যন্ত সত্য হয়নি। ওই সময় জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটস’-এর (মোট ৬টি) ভোটেই ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস ২৩১ বছরের, ১৭৮৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত (স্বাধীনতা ঘোষণা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)। তিনি ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী। জর্জ অ্যাডামসও ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রার্থী (১৭৯৭-১৮০১)। কিন্তু তৃতীয় প্রেসিডেন্টের (থমাস জেফারসনের, ১৮০১-১৮০৯) শাসনামল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান পার্টি একসঙ্গে একক প্রার্থী হিসেবে চার টার্মে ক্ষমতায় ছিল। সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের (১৮২৯-১৮৩৭) সময় থেকেই ডেমোক্র্যাট পার্টি আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। রিপাবলিকান পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (১৬তম প্রেসিডেন্ট, ১৮৬১-১৮৬৫)। সেই থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দুটি বড় দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির মাঝে সীমাবদ্ধ। প্রথম দিকে অবশ্য তৃতীয় একটি পার্টি উইগ পার্টির অস্তিত্ব ছিল। উইগ পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন (৯ম, ১৮৪১)। যদিও নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারেননি। ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। তিনি রিপাবলিকান দলের সদস্য। প্রতিটি নির্বাচনের সময়ই কিছু কিছু ‘ইস্যু’ প্রাধান্য পায়, যা ভোটারদের প্রভাবিত করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভোটাররা ভোট দেন। কিন্তু যিনি বিজয়ী হন তিনি ওই স্টেটের প্রতিটি ইলেকটোরাল কলেজের সবকটি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এবারেও ‘ইস্যু’ আছে। বিশেষ করে বর্ণবাদ, শে^তাঙ্গ ‘সুপ্রিমেসি’, ১১.১ ভাগ বেকার সমস্যা, কভিড-১৯ রোধে ব্যর্থতা, উৎপাদন খাতে ধস ও ব্যাপক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি, তথা দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর সূচনা সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাষ্ট্রপরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ভোটাররা তাকে দ্বিতীয় টার্মের জন্য বেছে নেবেন কি-না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তবে অনেকগুলো আশংকার কথা ইতিমধ্যেই উঠেছে। ট্রাম্প হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরে এলেও ওয়াশিংটন পোস্ট গত ৪ অক্টোবর তাদের এক প্রতিবেদনে হোয়াইট হাউজ থেকে ট্রাম্পের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আর নিউ ইয়র্ক পোস্ট ৫ অক্টোবর লিখেছে ‘The American People need the truth’ আমেরিকার জনগণ সত্যটি জানতে চায়। এর অর্থ কী? ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই অসুস্থ বা অসুস্থ নন কিন্তু সত্য কথাটি বলা হচ্ছে না! দুটো বড় মিডিয়া হাউজ যখন এ ধরনের কথা লেখে, তখন একটি প্রশ্ন থাকেই। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তিনি ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন। এটা বাধ্যতামূলক। ট্রাম্প মাত্র দুদিন হাসপাতালে থাকলেন। ১৪ দিন থাকলেন না। তাহলে কি জনমতকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি একটি ‘নাটক’ করলেন? যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি তাকে দিয়ে নাটক সাজাল? এর জবাব আমরা কোনো দিনই পাব না। মানুষ জানতেও পারবে না আসল ঘটনা। তিনি যদি কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তার উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার কথা। কোনো ডাক্তার কোনো কথা বললেন না, তিনি অসুস্থতাও প্রকাশ করলেন না, ওইদিন সকালেও তিনি ব্যস্ত সময় কাটালেন, তারপর হঠাৎ করেই টুইট করে জানালেন তিনি ও তার স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত! ফলে সন্দেহ ঘনীভূত হওয়া স্বাভাবিক। আর এই সন্দেহই প্রকাশ করেছেন মাইকেল মুর, যিনি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। লন্ডনের Independent আমাদের জানাচ্ছে ‘Michael Moore bloats conspiracy theory that Trump may be faking Covid diagnosis’। মুর তার ফেইসবুক পেজে উল্লেখ করেন ট্রাম্প করোনাভাইরাস নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন! তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন, ওটা মুরের অভিমত। Independent পত্রিকায় Graig Graziosi তার প্রতিবেদনে মুরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে মুর বলছেন ‘ট্রাম্প মিথ্যাবাদী। তিনি সব সময় মিথ্যা কথা বলেন। তিনি পরীক্ষিত একজন মিথ্যাবাদী। গত ৪ বছরে ২৫ হাজার বার মিথ্যা কথা বলেছেন। ’ মুর সত্য বলেছেন, কী মিথ্যা বলেছেন, এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে ট্রাম্পের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া, আবার দুই দিনের মাথায় ভালো হয়ে যাওয়া, সংবাদপত্রে তার অসুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সব মিলিয়ে একটা সন্দেহ তো থাকবেই। তাই আগামী দিনগুলোতে আরও বেশি ‘নাটক’ আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। এ ধরনের পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হেরে গেছেন নির্বাচনে এ ধরনের দৃষ্টান্ত আছে অনেক। কিন্তু ট্রাম্প বলে কথা! তিনি যে ক্ষমতা ছাড়তে চান না, আকার-ইঙ্গিতে ও বক্তব্যে তিনি একাধিকবার তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ^কে ‘গণতন্ত্র’ শেখাতে চায়, তার নিজের দেশেই গণতন্ত্র আজ বিপন্ন! ফলে নির্বাচন ও নির্বাচনের আগে যদি আরও কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে, আমি তাতে অবাক হব না। Desh Rupsntor 8.10.2020

2 comments: