মালেক কাহিনী
01:16
No comments
ড্রাইভার মালেকের ছবি ও ‘কাহিনী’ এখন সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। সফেদ দাড়িতে মালেককে দেখলে যেকোনো লোক তাকে সম্মানের চোখে দেখবেন। তার বেশ-বাস, তার অবয়ব দেখে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, তিনি একজন নামাজি মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত হয়তো নামাজ পড়েন! মসজিদে যান।মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও হয়তো চান, যা খুবই স্বাভাবিক। আমি জানি না তিনি হয়তো ইতিমধ্যে হজও করে এসেছেন। এই মালেকই এখন মিডিয়ার অন্যতম ‘চমক’। ‘চমক’ বলছি এ কারণে যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার। কিন্তু একজন ড্রাইভার হয়েও তার সম্পদের যে বিবরণ আমরা জানতে পেরেছি, তাতে রীতিমতো অবাক হতে হয়। ঢাকায় তার দুটি সাততলা ভবন। দশতলা অপর একটি ভবন নির্মাণাধীন। ব্যাংকে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। তার বাসার দরজা আর ওয়াশ রুমের যে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, শুধু রাজা-বাদশাহদের বাড়িতেই এমন কারুকাজ আমরা দেখতাম।অথচ তিনি ড্রাইভার। কত ক্ষমতাবান তিনি যে, ডিজির নামে বরাদ্দকৃত প্রাডো গাড়িটি নিজে ব্যবহার করেন। সংবাদপত্রের ভাষায় তার স্ত্রী, মেয়ে, মেয়ের জামাই, ভাইসহ অন্তত ৩০ জন চাকরি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।>এই মালেক ড্রাইভারই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এই সিন্ডিকেট সদস্যদের অনেকেই বছরের পর বছর অফিস করেন না। বদলি হন না। নিম্নপদস্থ কর্মচারী হয়েও ব্যবহার করেন সরকারি গাড়ি। বাসা বরাদ্দ নিয়েও তা ভাড়া দেন অন্যদের কাছে। একজন মালেক ড্রাইভারের ‘কাহিনী’ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। একজন ড্রাইভার যদি ঢাকায় ২৫ থেকে ৩০টি ফ্ল্যাটের মালিক হন, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে সমাজটা ঠিকমতো চলছে না! এ দেশে অনেক ত্যাগী ও গুণী মানুষ আছেন, যারা আজীবন সৎ থেকে গেছেন এবং শেষ বয়সে এসে সরকারি ‘বৃদ্ধনিবাসে’ বাস করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের এক সাবেক অধ্যাপকের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। সারাটা জীবন তিনি ছাত্র পড়ালেন। আর এখন তাকে থাকতে হচ্ছে ‘বৃদ্ধনিবাস’-এ। সুখের কথা তিনি ‘মালেক ড্রাইভার’দের মতো অসৎ লোকদের শিক্ষাজীবনে ‘জন্ম’ দেননি। সমাজটা কীভাবে পচে গেছে তার একটি বড় উদাহরণ একজন চিকিৎসক একটি টিভি চ্যানেলে প্রকাশ্যেই বলছেন ‘তিনি একজন মালেক ড্রাইভার’ হতে চান। একজন চিকিৎসক যিনি সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী হয়েই এমবিবিএস পাস করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি করছেন, তিনি কি না হতে চান মালেক ড্রাইভার। এই ‘মালেক ড্রাইভাররা’ সমাজকে কোথায় নিয়ে গেছেন, এটা একটা বড় উদাহরণ একজন চিকিৎসক কি না হতে চান ‘মালেক ড্রাইভার’! আমরা বুঝি এটা তার প্রতিবাদ। তিনি সত্যিকার অর্থেই ড্রাইভার হতে চান না। এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে বক্তব্যের মধ্যে।প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘মালেক ড্রাইভাররা’ এতদূর এলো কীভাবে? কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা এত বিপুল সম্পত্তির মালিক হন? এটা নিশ্চয়ই এক বছর কিংবা পাঁচ বছরে হয়নি। একটা চক্র সেখানে গড়ে উঠছে, যারা ‘মালেক ড্রাইভার’কে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এদের সবাইকে আজ আইনের আশ্রয়ে নেওয়া প্রয়োজন। একজন মালেক যদি ২৫ থেকে ৩০টি ফ্ল্যাটের মালিক হন, তাহলে অতীতে যারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক, পরিচালক পদে ছিলেন, এদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক সবার আয়কর ফাইল চাওয়া হোক। দুদকের দিকে মানুষ তাকিয়ে আছে। দুদককে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। একজন সাবেক মহাপরিচালকের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিনি গুলশানে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। সম্ভবত সেটি তার নিজের ফ্ল্যাট। কোন স্কেলে তিনি চাকরি করতেন? সেই স্কেলের টাকায় কি এত বড় ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব? কেনা সম্ভব? স্ত্রীকে ব্যবসায়ী বানিয়ে আইটির শত শত কোটি টাকার ‘ব্যবসা’ তিনি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। দুদক তাকে ডেকেছিল বটে। কিন্তু এর পরের খবর আর আমরা জানি না। সংবাদকর্মীরাও আর আমাদের ‘ফলোআপ’ সংবাদ জানাচ্ছেন না।দেশ রূপান্তর ‘বালিশ কাহিনী’ প্রকাশ করে সারা জাতির আস্থা অর্জন করেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রয়েছে এ ধরনের ‘শত শত বালিশ কাহিনী’। প্রকাশিত হোক ‘এসব বালিশ কাহিনী’। করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশ যখন এখনো একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন গত চার-পাঁচ মাস প্রায়শই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। সাহেদ, সাবরিনা, আরিফরা শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করে এখন ‘থালাবাটি কম্বল’ নিয়ে জেলহাজতে। দুর্নীতির খবর বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ‘অ্যাকশনে’ গেছে এটা সত্য। শতকোটি টাকার মালিক আবজালও এখন জেলে। ১৪টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে? এর জবাব সম্ভবত ‘না’। অর্থাৎ ‘কালো বেড়াল’রা ঘাপটি মেরে বসে আছে। একজন ‘মালেক ড্রাইভার’ ধরা খেয়েছেন তার রিমান্ড এখন চলছে ১৪ দিনের। মাত্র ২৬ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। রাজধানীতে দুটি বহুতল ভবন, প্রায় ২০ কাঠা জমির মালিক, গরুর খামার ও শতকোটি টাকার মালিক ‘মালেক ড্রাইভার’ তার আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি। সুতরাং তার সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হোক।ঢাকার প্রয়াত সাবেক এক মেয়রের গুলশানের বাড়ি অবৈধ অর্থে নির্মিত হয়েছিল রাষ্ট্র তাকে অনুগ্রহ করেনি। তার বাড়ি আইনগত প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছিল। আজ ‘মালেক ড্রাইভার’-এর ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হবে না কেন? এটা করা হলে একটা ‘মেসেজ’ পৌঁছে যাবে সবার কাছেই অবৈধ পন্থায় যারা সম্পদ আহরণ করছেন, তারা ‘ভয়ে’ থাকবেন। অন্তত একটা মেসেজ যাবে যে, সরকার কাউকে ছাড় দেয় না। মালেক ড্রাইভার শেষ চার বছর গাড়ি চালিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বর্তমান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের। মালেকের ‘মহাদুর্নীতির’ সঙ্গে তার সম্পৃক্ততাও খুঁজে বের করা দরকার। যদিও তিনি সংবাদপত্রে স্বীকার করেছেন ‘আমি ক্লিন ইমেজের মানুষ, মালেকের দায় আমার না’। তার এই বক্তব্যে মানুষ কতটুকু আস্থা রাখবে, এটা প্রশ্ন বটে। চার বছর মালেক তার গাড়ি চালালেন, তার আশপাশে থাকলেন, মালেকের ‘আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ পাওয়ার’ কাহিনী তিনি জানতেন না এ ধরনের বক্তব্যে আমি অন্তত আস্থা রাখতে পারছি না। নিশ্চয়ই দুদকের তদন্ত টিম এটি দেখবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কাহিনী’ ড্রাইভার মালেকের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই যে শেষ হয়েছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের মালেকরা আরও আছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ে তো কত ‘কাহিনী’! পর্দা থেকে শুরু, মাঝখানে সাহেদ-সাবরিনা আর এখন চলছে ‘মালেক কাহিনী’ এই কাহিনীর কোথায় শেষ আমরা তা জানি না। হয়তো কাল আমরা আরেক ‘কাহিনী’ জানতে পারব। করোনা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মহাদুর্নীতি’র খবর পত্রিকায় আসতে শুরু করল, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা বলতে শুরু করলেন তারা কিছুই জানেন না! ফাইলে স্বাক্ষর করলেন, অনুমোদন দিলেন, তারপরও যদি কেউ বলেন ‘তারা কিছু জানেন না’, তাহলে সবাইকে বোকা ভাবতে হবে! মালেক যার আন্ডারে কাজ করেন, ‘বিকল্প প্রশাসন’ গড়ে তুলেছেন(?), তিনি বললেন, ‘এ দায় তার না’! তাহলে দায়টা কার? আমজনতার? যাদের ট্যাক্সের টাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রথী-মহারথীদের বেতন হয়, তারা দায়ী? আমাদের দুঃখ এখানেই এই আমজনতাকে সবাই ‘বোকা’ ভাবে। সাধারণ মানুষ যে সবকিছু বোঝেন, এটা তারা বোঝেন না?স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যত দ্রুত ‘শুদ্ধি’ অভিযান চালানো যায়, ততই আমাদের মঙ্গল। রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ আর ডা. সাবরিনাদের কেলেঙ্কারির দায়ভার নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু শুধু ব্যক্তির বদলি এই অধিদপ্তরের সংস্কারের জন্য যথেষ্ট নয়। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশে ‘বড় আলোচনার’ জন্ম হয়েছিল। ওই ঘটনায় কক্সবাজারের এসপি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার বদলি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনা হলো কক্সবাজারের পুলিশের পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৭ জনকে দেশের বিভিন্ন থানায় বদলি করা হয়েছে। এটা একটা যুগান্তকারী ও ভালো সিদ্ধান্ত। কক্সবাজারের ক্ষেত্রে এমনটি করা গেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে এমনটি করা যায় কি না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা ভেবে দেখতে পারে। একটা ‘টোটাল চেঞ্জ’ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজদের উৎখাত করা যাবে না। একজন ‘ড্রাইভার’ যদি নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের বদলির বিষয়টি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে এই ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার পথ একটিই সবাইকে বদলি করা। নতুন ‘সেট-আপ’ নিয়ে আসা। না হলে ব্যক্তির ট্রান্সফার কিংবা একজন মালেকের গ্রেপ্তারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ‘বড় চেঞ্জ’ আসবে না। এটা লোক দেখানো একটা ‘চেঞ্জ’।করোনা নিয়ে সারা জাতি যখন উৎকণ্ঠিত, সরকার যখন স্বাস্থ্য খাতে অর্থের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, তখন এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ। বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে ‘ছয়-নয়’ হচ্ছে! সাহেদ, সাবরিনা আর মালেকরা ‘রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা’ ব্যবহার করে অনৈতিক পথে শত শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। সাহেদ সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে টিভি টকশোতে উপস্থিত হতেন আর এই ইমেজ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের ‘ব্যবহার’ করতেন। মালেকও তথাকথিত ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ‘বিকল্প প্রশাসন’ গড়ে তুলেছিলেন। অভিযোগ আছে, তার ‘নির্দেশ’ বা ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছাড়া সেখানে কোনো বদলি আদেশে স্বাক্ষর হতো না। একজন মালেক গ্রেপ্তার হয়েছেন। হয়তো তার বিচার হবে। কিন্তু অবৈধভাবে তিনি যে ‘সম্পদ’ অর্জন করলেন তার কী হবে? সাহেদরা জেলে আছেন। একসময় ‘অসুস্থ’ হয়ে হাসপাতালের ‘প্রিজন সেলে’ থাকবেন, যেমনটি থাকছেন সম্রাটরা!শত শত কোটি টাকা ‘চুরি’ করে যদি জেলেও যেতে হয়, মন্দ কি! একসময় মানুষ সব ভুলে যাবে। আরেকটি ‘মালেকের মতো ঘটনার’ জন্ম হবে। এই মালেকদের যত দিন না দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা দিতে পারব, তত দিন হাজারটা প্রতিবেদন লিখেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না;
Desh Rupantor
>1.10.2020<
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment