বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যে
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বলে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে
শুরু করেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরও বাড়বে। অসময়ে বন্যা হবে।
উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের
প্রবণতা বাড়বে। লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। বড় বড় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তু
মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি
গেল সপ্তাহে বাংলাদেশজুড়ে যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়, তাতে সে প্রশ্নটিই আবার আলোচনায় নতুন মাত্রা পেল, তা হচ্ছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে কি শুরু করেছে? পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ছিল ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা যে জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি হয়েছিল, যা কপ-২১ নামে পরিচিত। পরে জাতিসংঘে ২০১৬ সালে ১৭০টি দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করে। কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তিটি মানতে অস্বীকার করছেন। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ কারণে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। সাহারা মরুভূমিতেও এখন বরফ পড়ছে। কানাডায় তাপমাত্রা নেমে গেছে মাইনাস ৩০ ডিগ্রির নিচে। প্যারিসে ও পরে জাতিসংঘে একটি চুক্তি হয়েছিল বটে, তবে বিভক্তি আছে। বিশ্বের দেশগুলো এখনও বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা রয়েছে। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১ এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর, অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশিÑ শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭ এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বে জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ছিল ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্বজনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের, আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিতÑ এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সেই প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়। সে কারণে এই দুটি দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ্ব; কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিলÑ ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুই দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৪৯০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ। ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়, তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা ছিল। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সব দেশকে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজকলমেই থেকে গিয়েছিল। তবে প্যারিসে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অনত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন ‘কপ’ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। অতীতে ‘কপ’ (COP) এর দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হবে, যাতে এই দেশগুলো জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে। উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখান থেকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। বলা হয়েছিল, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছিল (২০১৫), তা নিউইয়র্কে একটি চুক্তি সময়ের মধ্য দিয়ে কতটুকু কার্যকরী হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশবাদী আল গোর নিজে একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেনÑ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অনত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন; সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক-জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহরে মানুষের ভাষায় ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। এই ‘জলবায়ু উদবাস্তু’দের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহায্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাহায্যের ব্যবহার নিয়ে নানা অনিয়মের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার এমন অনিয়ম রোধ করতে পেরেছে। এখন বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই চুক্তি কতটুকু কার্যকরী হয়, তা নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিতও। ৩ বছর আগে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট ২০১৪ ঢাকায় এডিবির এই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরবর্তনসংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা ঘটা করে ‘কপ’ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরই মধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেনÑ বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় এরই মধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায় শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় এখনও কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে তিনি বলেছেন, তিনি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। এখন যদি জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকে, তাহলে জলবায়ু চুক্তিটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকবেই।
বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বলে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরও বাড়বে। অসময়ে বন্যা হবে। উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে। লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। বড় বড় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি। এজন্য আমরা আদৌ দায়ী নই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সুতরাং কপ-২১ এ যে সিদ্ধান্তটি হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন জরুরি ছিল। কিন্তু তাতে এখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের মতো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যদি বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকি, তাহলে আমরা ভুল করব। নিজস্ব উৎস ব্যবহার করে, নিজস্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করে, দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে আমরা নিজ উদ্যোগে উষ্ণতা রোধকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি। আমাদের এ ব্যর্থতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। সারা বিশ্বেই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উপাদনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশকিছু দেশ (যেমন জার্মানি)। অথচ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কয়লানির্ভর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার। এক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে দেখা উচিত ছিল। সোলার এনার্জি বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও আমরা এর ব্যবহার বাড়াতে পারিনি। সুতরাং চলতি বছরের শুরুতে অতিরিক্ত শীত পড়ার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তা মনে করিয়ে দিল। সুতরাং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এখনই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
Daily Alokito bangladesh
14.01.2018
গেল সপ্তাহে বাংলাদেশজুড়ে যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়, তাতে সে প্রশ্নটিই আবার আলোচনায় নতুন মাত্রা পেল, তা হচ্ছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে কি শুরু করেছে? পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ছিল ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা যে জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি হয়েছিল, যা কপ-২১ নামে পরিচিত। পরে জাতিসংঘে ২০১৬ সালে ১৭০টি দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করে। কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তিটি মানতে অস্বীকার করছেন। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ কারণে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। সাহারা মরুভূমিতেও এখন বরফ পড়ছে। কানাডায় তাপমাত্রা নেমে গেছে মাইনাস ৩০ ডিগ্রির নিচে। প্যারিসে ও পরে জাতিসংঘে একটি চুক্তি হয়েছিল বটে, তবে বিভক্তি আছে। বিশ্বের দেশগুলো এখনও বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা রয়েছে। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১ এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর, অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশিÑ শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭ এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বে জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ছিল ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্বজনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের, আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিতÑ এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সেই প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়। সে কারণে এই দুটি দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ্ব; কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিলÑ ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুই দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৪৯০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ। ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়, তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা ছিল। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সব দেশকে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজকলমেই থেকে গিয়েছিল। তবে প্যারিসে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অনত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন ‘কপ’ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। অতীতে ‘কপ’ (COP) এর দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হবে, যাতে এই দেশগুলো জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে। উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখান থেকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। বলা হয়েছিল, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছিল (২০১৫), তা নিউইয়র্কে একটি চুক্তি সময়ের মধ্য দিয়ে কতটুকু কার্যকরী হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশবাদী আল গোর নিজে একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেনÑ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অনত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন; সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক-জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহরে মানুষের ভাষায় ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। এই ‘জলবায়ু উদবাস্তু’দের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহায্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাহায্যের ব্যবহার নিয়ে নানা অনিয়মের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার এমন অনিয়ম রোধ করতে পেরেছে। এখন বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই চুক্তি কতটুকু কার্যকরী হয়, তা নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিতও। ৩ বছর আগে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট ২০১৪ ঢাকায় এডিবির এই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরবর্তনসংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা ঘটা করে ‘কপ’ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরই মধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেনÑ বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় এরই মধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায় শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় এখনও কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে তিনি বলেছেন, তিনি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। এখন যদি জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকে, তাহলে জলবায়ু চুক্তিটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকবেই।
বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বলে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরও বাড়বে। অসময়ে বন্যা হবে। উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে। লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। বড় বড় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি। এজন্য আমরা আদৌ দায়ী নই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সুতরাং কপ-২১ এ যে সিদ্ধান্তটি হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন জরুরি ছিল। কিন্তু তাতে এখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের মতো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যদি বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকি, তাহলে আমরা ভুল করব। নিজস্ব উৎস ব্যবহার করে, নিজস্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করে, দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে আমরা নিজ উদ্যোগে উষ্ণতা রোধকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি। আমাদের এ ব্যর্থতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। সারা বিশ্বেই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উপাদনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশকিছু দেশ (যেমন জার্মানি)। অথচ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কয়লানির্ভর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার। এক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে দেখা উচিত ছিল। সোলার এনার্জি বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও আমরা এর ব্যবহার বাড়াতে পারিনি। সুতরাং চলতি বছরের শুরুতে অতিরিক্ত শীত পড়ার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তা মনে করিয়ে দিল। সুতরাং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এখনই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
Daily Alokito bangladesh
14.01.2018
0 comments:
Post a Comment