রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে



বলতে দ্বিধা নেই, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এ দ্বন্দ্বের কারণে তিন-তিনবার দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর মাঝে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দু-দুবারÑ ১৯৪৭-৪৮ সালে একবার, আর ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে কারগিলকে কেন্দ্র করে আরও একবার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতা দখল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা, আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। ভারত পরপর দু-বার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ওই ঘটনা পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সিপরির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৩৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, আর ভারতের রয়েছে ১২৫টি। ২০১৭ সালে উভয় দেশ ১০টি করে ওয়ারহেড তাদের পারমাণবিক শক্তিবহরে সংযুক্ত করে (Knoema, January 23, 2018))। ভারত ইতোমধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পাঁচটি আকাশ প্রতিরক্ষার মিসাইল এস-৪০০ কিনতে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই এ চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় তারা। তাহলে পরবর্তী ২৪ থেকে ৫৪ মাসের মধ্যে এসব অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহ শেষ হবে। ৩০ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে এ মিসাইল সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর আগে জানুয়ারিতে (২০১৮) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ভারত ৭ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এস-৪০০ মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম। তাদের মতে, বহুমুখী ব্যবহার-উপযোগী এস-৪০০ এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই পাল্টে দেবে। এই মিসাইলটি পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক মিসাইল নসরকেও নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই অস্ত্র চুক্তি নতুন নয়। তবে নিঃসন্দেহে এই চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে অন্যতম বড় চুক্তি। এর আগে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার দিয়ে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্য কিনেছিল ভারত। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের এই অস্ত্র ক্রয় পাকিস্তানকেও উদ্বুদ্ধ করবে তাকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতে। ফলে নতুন করে উপমহাদেশে আবারও অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা উপমহাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। অস্ত্র খাতে ব্যয় বরাদ্দ বেড়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার, আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার, আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন বলা যেতে পারে, একটি ট্যাংকের যে দাম, ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রাণঘাতী অসুখবিসুখ ঠেকানোর জন্য ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ৬ রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র ১ ডলার। একটি মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের (যা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছে) দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড়পড়তা খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি ডুবোজাহাজের দাম ধরা হয় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে এক বছরের জন্য একজনকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে মোটামুটি ৫ ডলারের মতো ব্যয় হয়। অর্থাৎ একটি ডুবোজাহাজ কেনা মানে ৬ কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। ভারত ও পাকিস্তানে দরিদ্রতা আছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারতে কৃষক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। অথচ এই দেশ দুটিতে সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতিসামান্যই। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ফলে উত্তেজনা থাকবেই। চিরবৈরী এই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো ভালো খবর নয়। গত দু-তিন বছর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। ১৩ ডিসেম্বর (২০০১) ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ওই হামলায় পাঁচ হামলাকারীসহ ১৩ জন নিহত হয়েছিল। ভারত ওই হামলার জন্য কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লস্কর-ই-তৈয়্যবা’ এবং ‘জয়শ-ই-মোহাম্মদ’কে দায়ী করেছিল এবং এ দুই জঙ্গি সংগঠনকে মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর ফিরে আসেনি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির লাহোর সফর (১৯৯৯) ও সাবেক পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আগ্রা সফরের (২০০১) পর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে; কিন্তু তা হয়নি। বরং দেশ দুটির মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাকিস্তান মনে করে, ভারত বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের দিয়ে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকা- করাচ্ছে! অতিসম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন চাচ্ছে, ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। কিন্তু পাকিস্তানের তাতে রয়েছে জোর আপত্তি। দেশ দুটির মধ্যকার বৈরিতার কারণে পাকিস্তানে ২০১৬ সালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ভারত ওই সম্মেলন বয়কট করেছিল। ফলে সম্মেলনটি আর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক অনির্ধারিত সফরে লাহোর গিয়েছিলেন। সেটা ছিল গত ১২ বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম পাকিস্তান সফর। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উরির ঘটনাবলিতে সম্পর্ক উন্নত করার সব সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। ওই ঘটনায় জঙ্গিগোষ্ঠী জয়শ-ই-মোহাম্মদ ১৮ ভারতীয় সৈনিককে হত্যা করেছিল। ওই হত্যাকা- সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। গত বছর সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এখন বছরের শুরুতেই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার খবর প্রকাশিত হলো। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা উপমহাদেশে শুধু উত্তেজনাই বাড়বে না, বরং উপমহাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
Daily Alokito Bangladesh
28.01.2018

0 comments:

Post a Comment