এক. খালেদা জিয়া আদৌ জামিনে মুক্তি পাবেন কি না? দুই. খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না? তিন. খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না? চার. নির্বাচনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যাবে কি না? পাঁচ. এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্ট্র্যাটেজি কী হবে?
চলতি সপ্তাহে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার জন্য জামিন চাওয়া হতে পারে। সাধারণত এসব মামলায় উচ্চ আদালত জামিন দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না একটি মামলায়, অর্থাৎ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জামিন পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অন্য কোনো মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়নি। কুমিল্লার দুটি মামলায় হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। বাকি তিনটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ—এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্রের যাঁরা সিরিয়াস পাঠক, তাঁরা লক্ষ করে থাকবেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে দুর্নীতি, ভুয়া জন্মদিন, মানুষ হত্যা, নাশকতা, মানহানিসহ নানা অভিযোগে ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলা দুর্নীতির। গ্যাটকো, নাইকো, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলা দুর্নীতিসংক্রান্ত। এসব মামলার মধ্যে চারটি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, বাকি মামলাগুলো বর্তমান সরকারের আমলে করা হয়। খালেদা জিয়ার মামলার মধ্যে ১৯টি মামলা বিচারাধীন। আর তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে ১২টি মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া জামিন যদি পানও অন্যান্য মামলায় তাঁকে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারি ও ৪ মার্চ পৃথক দুটি মামলায় খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত করতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজিরা পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার—খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে যেতে হচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য তাঁকে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত! ডিসেম্বরে নির্বাচন।
ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারবেন কি না এটা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানের ৬৬(২) (খ)-তে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’ খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধারাটি একটি অন্তরায়। এই ধারা অনুযায়ী তিনি যোগ্য নন! কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়কে পূর্ণাঙ্গ রায় বলে ধরে নেওয়া হয় না। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল হবে এবং সেখানেও যদি খালেদা জিয়া ব্যর্থ হন, তিনি যাবেন আপিল বিভাগে। এমনকি নির্বাচন কমিশন যদি তাঁর প্রার্থীপদ অযোগ্য ঘোষণা করে, তার পরও তাঁকে উচ্চ আদালতে যেতে হবে। ফলে খালেদা জিয়ার প্রার্থীপদ এখন অনেকটাই আদালতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সময়টা কম। মাত্র আট মাস। নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণা করা হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। এই স্বল্প সময়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁর প্রার্থীপদ নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই গেল। উপরন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা একাধিক। যেকোনো মামলায় তাঁর ‘দণ্ডাদেশ’ হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন! এটি বিবেচনায় নিয়েই বিএনপিকে এখন স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। তাহলে বিএনপি এখন কী করবে?
বিএনপি স্থায়ী কমিটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না’! এমনকি খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরও বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, খালেদা জিয়াকে বাদ রেখে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না! আমি মনে করি না এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত। মালয়েশিয়ার প্রধান বিরোধী দলনেতা আনোয়ার ইবরাহিম যখন জেলে ছিলেন, তাঁর দল ‘পিপলস জাস্টিস পার্টি’ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তিনি জেলে থাকায় তাঁর প্রার্থীপদ অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল এবং তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজা ওয়ান ইসমাইল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা রোবেন দ্বীপের নির্জন জেলে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ২৭ বছর। কিন্তু তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে বর্ণবাদ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনা বন্ধ করেনি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন (১৯৯৪-১৯৯৯)। তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি মাত্র এক টার্ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভারতে চৌধুরী চরণ সিংয়ের সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু তিনি অবিসংবাদিত এক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের জেলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁরা ফিরেও আসেন বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে। খালেদা জিয়ার জেলে গমন তাঁকে আরো শক্তিশালী নেতায় পরিণত করেছে। তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বৈ কমেনি। আইনগতভাবে তিনি যদি চূড়ান্ত বিচারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে নাও পারেন, বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। নির্বাচন বয়কট কোনো সমাধান হতে পারে না।
অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচন বয়কট করেও (২০১৪) বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়াই যে সংসদ গঠিত হয়েছিল (দশম জাতীয় সংসদ), সেই সংসদ এখনো টিকে আছে। ফলে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে—এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। বাস্তবতাই হচ্ছে বিএনপি বড় দল। সংসদে ওই মুহূর্তে না থাকলেও বিএনপিই প্রধান বিরোধী দল। জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে সংসদীয় রাজনীতি চালু রয়েছে বটে, কিন্তু মানুষ এটি গ্রহণ করে নেয়নি। গত চার বছর প্রকৃত অর্থেই বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। তবে এটি স্বীকার করতেই হবে, জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির কিছু নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাব, সংসদে বিরোধী দলের নেতার ব্যর্থতা কিংবা পার্টি চেয়ারম্যানের ‘কমিটমেন্ট’-এর অভাব জাতীয় পার্টিকে প্রকৃত অর্থেই সরকারের ‘বি টিমে’ পরিণত করেছে। সাধারণ মানুষ এই দলটিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দেখছে না। বিকল্প হিসেবে দেখছে বিএনপিকেই! তবে জাতীয় পার্টির জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়। তাই সব কিছুই নির্ভর করছে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের ওপর। আর জাতীয় পার্টিকেও তার ‘রাজনীতি’ স্পষ্ট করতে হবে। হয় সরকারে, নতুবা বিরোধী দলে। জাতীয় পার্টি যদি সরকারে থাকে, তাহলে সরকার শক্তিশালী হবে।
সরকারের শরিক অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের চেয়ে জাতীয় পার্টির সারা দেশে অবস্থান ভালো। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র দল নিয়ে ‘মালয়েশিয়ান মডেলে’ একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতেই পারে। আবার বিরোধী দলে থাকলে সত্যিকার অর্থেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ভুলত্রুটিগুলো উল্লেখ করে সংসদে প্রকৃত অর্থেই প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব। আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। দেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। প্রচুর উন্নয়নের কাজ করছে আওয়ামী লীগ। সরকারের এসব কর্মকাণ্ডকেই পুঁজি করবে আওয়ামী লীগ। তবে এটাও সত্য, একটি ‘অংশীদারিমূলক’ নির্বাচনের জন্য সরকারের বড় উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। এরই মধ্যে এর আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি ভেঙে গেলে এর দায় বর্তাবে সরকারের ওপর! মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। দুই-একজন সিনিয়র নেতা ছাড়া স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা ‘আন্দোলনে’ নেই। কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও নেতাদের নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। সুযোগসন্ধানীরা দল ভাঙতে পারে। কেউ কেউ এমপি হতে চাইবেন—এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘ধানের শীষ’-এর প্রতীক তাঁরা পাবেন বলে মনে হয় না। ফলে ‘খালেদা জিয়া মাইনাস’—সেই বিএনপির কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় খালেদা জিয়ার তথা বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে। বিএনপিকে এখন আইনি মোকাবেলা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হবে। বিএনপি যদি অন্যান্য দলের সঙ্গে ন্যূনতম একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলে, তাও দলটির জন্য মঙ্গল। নির্বাচনকে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবেই বিএনপিকে বিবেচনা করতে হবে। দেশে যাতে একটি ‘সুস্থ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন হয়, সেই লক্ষ্যে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। সমস্যাটা বিএনপির জন্য ভালো নয়, এটা স্বীকার করি। এর মাধ্যমেই কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে হবে। বিএনপির স্থানীয় নেতারাও খুব একটা স্বস্তিতে আছেন এটা মনে করি না। মামলা-মোকদ্দমায় তাঁরা ব্যতিব্যস্ত। তার পরও নির্বাচনের প্রস্তুতি তাঁদের নিতে হবে। আগামী পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত যদি তাদের সংসদের বাইরে থাকতে হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কোনো কোনো পক্ষ বিএনপিকে আদালতকেন্দ্রিক ব্যস্ত রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে চায়। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে বাদ রাখলে ‘নানা জটিলতা’ তৈরি হবে। এটি সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও চান বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আর বিএনপি নির্বাচনে এলেই একটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর আমরা এমনটাই চাই।
Daily Kalerkontho
20.02.2018
0 comments:
Post a Comment