গত
৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে জনসভা করে নির্বাচনী
প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। আর খালেদা জিয়া ওই দিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট
দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দেন। ওই দিন আরও দুটো ঘটনা ঘটেছে। কূটনীতিকদের
কাছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করেছে বিএনপি। বিশেষ করে জিয়া চ্যারিটেবল
ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে, সে
ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। একই দিন ঢাকায় কদম ফোয়ারার
মোড়ে বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, ভাংচুর ও প্রিজন ভ্যানের তালা
ভেঙে আটক দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি একটি
বড় দলের প্রধান নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছেন, আর অপর একটি বড় দলের প্রধান
মামলায় হাজিরা দিয়েছেন। রাজনীতির এ দৃশ্য কিছুটা হলেও বেমানান।
এরই মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে- কী হবে ৮ ফেব্রুয়ারি? ওইদিন খালেদা জিয়ার
মামলার রায় দেয়া হবে। এ রায় নিয়েও এখন টানটান উত্তেজনা। কী হতে পারে রায়ে?
খালেদা জিয়ার সাজা? খালাস? সাজা হলে দলের কী হবে? এসবই এখন বড় প্রশ্ন। রায়
দেবেন আদালত। তথ্য-উপাত্ত, আইন ইত্যাদি বিবেচনা করে বিচারক রায় দেবেন। এই
রায়ই চূড়ান্ত রায় নয়। বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি
বা তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এরপর আপিল বিভাগে যাওয়ারও সুযোগ আছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি নিঃসন্দেহে একটি স্পর্শকাতর মামলা। এ
মামলার মেরিট আছে কী নেই তা বিবেচনায় না নিয়েই কোনো কোনো মন্ত্রী যখন
আগেভাগেই বলে দেন, ‘খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে’, তখন গুজবের ডালপালা গজায়
বৈকি! এ ধরনের বক্তব্য না দেয়াই মঙ্গল, কারণ তা আদালত অবমাননার শামিল।
যা হোক, এ মামলার রায় চলমান রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ সিদ্ধান্তের পেছনে বিএনপির নেতারা যে বক্তব্যই দিন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে একাধিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে দলটি। তাছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে নির্বাচন করতে পারবেন না, এ ধরনের কোনো সুস্পষ্ট বিধি নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেও নির্বাচন করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিএনপি একটি আইনি ব্যাখ্যা নিতে পারে। সাধারণত নিন্ম আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তাই কেউ সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার চাইতে পারে। সেটাই মঙ্গল। সেটাই শ্রেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় ‘রাজনীতি’ হচ্ছে। এটা নিয়ে বিএনপি যেমন রাজনীতি করছে, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও রাজনীতি করছে। মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পারতেন। একইভাবে একজন শীর্ষ বিএনপি নেতা বলেছেন, ‘সরকারের আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত প্রকাশ পায়...।’ তিনি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? এটাও তো আদালত অবমাননার শামিল। আদালত তো ‘সরকারের আদিষ্ট’ হয়ে কোনো রায় দেন না। এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তি বাড়ায়। পুলিশের গাড়িতে হামলা, কর্মী ছিনিয়ে নেয়া, রাইফেল ভেঙে ফেলা(?) ইত্যাদি আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নির্বাচনী বছর। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবেই। কিন্তু তা হতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যদি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, তাহলে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
একটি ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, যা ছিল সংবিধানসম্মত। কিন্তু নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনাবলি জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল, বিএনপির রাজনীতিকে তা একটা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিএনপি এক ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছিল। সেই থেকে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে পালন করে আসছে। দিনটিকে আওয়ামী লীগ পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে, অন্যদিকে বিএনপি এ দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও আমরা এটা প্রত্যক্ষ করলাম। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকলই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চলমান রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেবে? এটা সত্য, সাধারণ মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। সহিংস আন্দোলন করে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সরকারের চার বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা এর বড় প্রমাণ। সরকারপ্রধান তার চার বছরের কর্মকাণ্ডের একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন তার ১২ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। বুঝতে বাকি থাকে না, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উন্নয়নের এ কর্মকাণ্ডকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু বছরের শুরুতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুটি বড় দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে একটি হতাশার জায়গা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাখ্যা দেননি, তেমনি বিএনপিও ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ধারণা করা যায়, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ সময় একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। ওই মন্ত্রিসভায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রতিনিধি থাকবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। কিন্তু এ মন্ত্রিসভায় বিএনপির থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা বিএনপি এ মুহূর্তে সংসদে নেই। যে দলটি সংসদে নেই, তার প্রতিনিধিত্ব মন্ত্রিসভায় কীভাবে নিশ্চিত হবে? সাংবিধানিকভাবে এ সুযোগটি নিশ্চিত করতে হলে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের আগেই পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তাতে করে জনমনে আশঙ্কা বাড়ছে। একটি সংলাপের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হলেও সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তাই খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা, বিএনপির নির্বাচন বয়কটের হুমকি আবারও দেশটিকে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আগামী দিনগুলোয় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে থাকবে বারবার। দুটি বড় দলই তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনঢ়। এ ক্ষেত্রে জট কীভাবে খুলবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থার সম্পর্কটি এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আস্থার সম্পর্কটি জরুরি এ কারণে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অংশে দু’দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। একদলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। অপরদিকে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, এই দলটি জন্মের পর থেকে যতবার ভাঙনের মুখে পড়েছে, অন্য কোনো দল ততবার ভাঙনের মুখে পড়েনি। অতীতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান কিংবা কাজী জাফর আহমেদ, যারাই দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বেরিয়ে গেছেন, তারা রাজনীতির প্রশ্নের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ তথা সুবিধাবাদিতার কারণেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূলধারাটি ধরে রেখেছেন বটে, কিন্তু তার অবর্তমানে দলের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে মূলধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউই সুবিধা করতে পারেননি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে গেছেন, এখন আবার দলের বাইরে। তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা ক্যারিশমা কোনোটাই নেই। কাজেই মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না। আরও একটা কথা- তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) ফলাফল থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০ আসন, (৪৬.৬৬ ভাগ), আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন (২৯.৩৩ ভাগ), জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন (১১.৬৬), আর জামায়াত ১৮ আসন (৬ ভাগ)। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন (৩৭.০৪), বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১), জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৪), জামায়াত ৩ (৮.৬১)। ৮ম জাতীয় সংসদে (২০০১) বিএনপি ১৯৩ (৪৪.৯৭), আওয়ামী লীগ ৬২ (৪০.১৩), জাতীয় পার্টি ১৪ (৭.২৫), জামায়াত ১৭ (৪.২৮)। ৯ম জাতীয় সংসদে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ২৩০ (৪৯), বিএনপি ৩০ (৩৩.২), জাতীয় পার্টি ২৭ (৭), জামায়াত ২ (৪.৬)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা সাধারণভাবে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আস্থাশীল। ফলে সংসদীয় রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এই আস্থার সম্পর্ক না থাকলে সংসদীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, এর আগে আরও কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এ দুটি বড় দল অংশ নেবে। ফলে এখানে যদি আস্থার সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তাহলে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এখন যেদিকে টার্ন নিচ্ছে, তা দুটো বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। আমাদের শঙ্কাটা এখানেই। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের ওপর হামলার যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরাও এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিলাম। বাসে আগুন দেয়া আর বার্ন ইউনিটে অনেক মানুষের আর্তনাদের দৃশ্য এক আস্থাহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। সেই রাজনীতি থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্রের ‘দ্বিতীয় যাত্রা পথে’ হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু গত ২৬ বছরে সংসদীয় রাজনীতি নিয়ে আমরা খুব বেশি দূর যেতে পারিনি। আশাব্যঞ্জক তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিগত ২৬ বছরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হতে পারত। কিন্তু হয়নি। তাই ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যখন গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়ে পড়ছে বলে জানায়, আমি তাতে অবাক হই না।
সহিংসতা গণতন্ত্র বিকাশের অনুকূল কিছু হতে পারে না। ঠিক তেমনি আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিতও হয় না। আমরা গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখেছি। গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেইনি। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। কেননা আমরা মনে করেছিলাম, একটি নিরপেক্ষ সরকার আমাদের একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। সেটা দিয়েও ছিল। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তা গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। কিন্তু আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনের পর আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু পারেনি। তাই আবারও প্রশ্ন উঠল দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন। আবার সংবিধান সংশোধন হল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হল। কিন্তু ওই নির্বাচন (দশম জাতীয় সংসদ) আমাদের জন্য কোনো সুখের বার্তা বয়ে আনেনি। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। আস্থাহীনতার সম্পর্ক এত ব্যাপক ও গভীর যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আবার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিএনপি যদি সত্যি সত্যিই নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচনের যে দাবি তা নিশ্চিত হবে কীভাবে?
নির্বাচন হতে এখনও বাকি ন’মাস। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সহায়ক সরকারের’ দাবি অসাংবিধানিক। এটাই সত্য। আর এ সত্যটা মেনেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। এ ছাড়া বিএনপির কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক পথেই যেতে হবে। পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে তা এখন বিএনপিকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। যদিও মির্জা ফখরুল বলেছেন, যারা মিছিল থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে তারা বহিরাগত। তারা যে সত্যি সত্যিই বহিরাগত তা বিএনপিকেই এখন প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির মিছিল থেকে যখন পুলিশের ওপর হামলা হয়, তখন বিএনপি এর দায় এড়াতে পারে না।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হওয়ার পরপরই রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিএনপিকে ‘পজিটিভ’ রাজনীতিতে আসতে হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায় যাই হোক না কেন, বিএনপিকে আইনি মোকাবেলা করেই আগামী নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। সেসব বক্তব্য নিয়েই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এটা সত্য বিএনপিকে কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করতে হবে। আর কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করেই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই একটি স্থিতিশীল রাজনীতি। চাই সন্ত্রাসমুক্ত রাজনীতি। সন্ত্রাসমুক্ত ও স্থিতিশীল রাজনীতিই পারে বাংলাদেশের জনগণকে একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে।
Daily Jugantor
03.02.2018
যা হোক, এ মামলার রায় চলমান রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ সিদ্ধান্তের পেছনে বিএনপির নেতারা যে বক্তব্যই দিন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে একাধিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে দলটি। তাছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে নির্বাচন করতে পারবেন না, এ ধরনের কোনো সুস্পষ্ট বিধি নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেও নির্বাচন করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিএনপি একটি আইনি ব্যাখ্যা নিতে পারে। সাধারণত নিন্ম আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তাই কেউ সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার চাইতে পারে। সেটাই মঙ্গল। সেটাই শ্রেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় ‘রাজনীতি’ হচ্ছে। এটা নিয়ে বিএনপি যেমন রাজনীতি করছে, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও রাজনীতি করছে। মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পারতেন। একইভাবে একজন শীর্ষ বিএনপি নেতা বলেছেন, ‘সরকারের আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত প্রকাশ পায়...।’ তিনি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? এটাও তো আদালত অবমাননার শামিল। আদালত তো ‘সরকারের আদিষ্ট’ হয়ে কোনো রায় দেন না। এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তি বাড়ায়। পুলিশের গাড়িতে হামলা, কর্মী ছিনিয়ে নেয়া, রাইফেল ভেঙে ফেলা(?) ইত্যাদি আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নির্বাচনী বছর। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবেই। কিন্তু তা হতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যদি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, তাহলে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
একটি ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, যা ছিল সংবিধানসম্মত। কিন্তু নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনাবলি জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল, বিএনপির রাজনীতিকে তা একটা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিএনপি এক ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছিল। সেই থেকে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে পালন করে আসছে। দিনটিকে আওয়ামী লীগ পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে, অন্যদিকে বিএনপি এ দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও আমরা এটা প্রত্যক্ষ করলাম। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকলই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চলমান রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেবে? এটা সত্য, সাধারণ মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। সহিংস আন্দোলন করে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সরকারের চার বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা এর বড় প্রমাণ। সরকারপ্রধান তার চার বছরের কর্মকাণ্ডের একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন তার ১২ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। বুঝতে বাকি থাকে না, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উন্নয়নের এ কর্মকাণ্ডকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু বছরের শুরুতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুটি বড় দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে একটি হতাশার জায়গা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাখ্যা দেননি, তেমনি বিএনপিও ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ধারণা করা যায়, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ সময় একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। ওই মন্ত্রিসভায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রতিনিধি থাকবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। কিন্তু এ মন্ত্রিসভায় বিএনপির থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা বিএনপি এ মুহূর্তে সংসদে নেই। যে দলটি সংসদে নেই, তার প্রতিনিধিত্ব মন্ত্রিসভায় কীভাবে নিশ্চিত হবে? সাংবিধানিকভাবে এ সুযোগটি নিশ্চিত করতে হলে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের আগেই পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তাতে করে জনমনে আশঙ্কা বাড়ছে। একটি সংলাপের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হলেও সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তাই খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা, বিএনপির নির্বাচন বয়কটের হুমকি আবারও দেশটিকে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আগামী দিনগুলোয় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে থাকবে বারবার। দুটি বড় দলই তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনঢ়। এ ক্ষেত্রে জট কীভাবে খুলবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থার সম্পর্কটি এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আস্থার সম্পর্কটি জরুরি এ কারণে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অংশে দু’দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। একদলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। অপরদিকে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, এই দলটি জন্মের পর থেকে যতবার ভাঙনের মুখে পড়েছে, অন্য কোনো দল ততবার ভাঙনের মুখে পড়েনি। অতীতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান কিংবা কাজী জাফর আহমেদ, যারাই দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বেরিয়ে গেছেন, তারা রাজনীতির প্রশ্নের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ তথা সুবিধাবাদিতার কারণেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূলধারাটি ধরে রেখেছেন বটে, কিন্তু তার অবর্তমানে দলের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে মূলধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউই সুবিধা করতে পারেননি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে গেছেন, এখন আবার দলের বাইরে। তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা ক্যারিশমা কোনোটাই নেই। কাজেই মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না। আরও একটা কথা- তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) ফলাফল থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০ আসন, (৪৬.৬৬ ভাগ), আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন (২৯.৩৩ ভাগ), জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন (১১.৬৬), আর জামায়াত ১৮ আসন (৬ ভাগ)। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন (৩৭.০৪), বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১), জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৪), জামায়াত ৩ (৮.৬১)। ৮ম জাতীয় সংসদে (২০০১) বিএনপি ১৯৩ (৪৪.৯৭), আওয়ামী লীগ ৬২ (৪০.১৩), জাতীয় পার্টি ১৪ (৭.২৫), জামায়াত ১৭ (৪.২৮)। ৯ম জাতীয় সংসদে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ২৩০ (৪৯), বিএনপি ৩০ (৩৩.২), জাতীয় পার্টি ২৭ (৭), জামায়াত ২ (৪.৬)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা সাধারণভাবে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আস্থাশীল। ফলে সংসদীয় রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এই আস্থার সম্পর্ক না থাকলে সংসদীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, এর আগে আরও কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এ দুটি বড় দল অংশ নেবে। ফলে এখানে যদি আস্থার সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তাহলে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এখন যেদিকে টার্ন নিচ্ছে, তা দুটো বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। আমাদের শঙ্কাটা এখানেই। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের ওপর হামলার যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরাও এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিলাম। বাসে আগুন দেয়া আর বার্ন ইউনিটে অনেক মানুষের আর্তনাদের দৃশ্য এক আস্থাহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। সেই রাজনীতি থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্রের ‘দ্বিতীয় যাত্রা পথে’ হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু গত ২৬ বছরে সংসদীয় রাজনীতি নিয়ে আমরা খুব বেশি দূর যেতে পারিনি। আশাব্যঞ্জক তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিগত ২৬ বছরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হতে পারত। কিন্তু হয়নি। তাই ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যখন গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়ে পড়ছে বলে জানায়, আমি তাতে অবাক হই না।
সহিংসতা গণতন্ত্র বিকাশের অনুকূল কিছু হতে পারে না। ঠিক তেমনি আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিতও হয় না। আমরা গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখেছি। গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেইনি। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। কেননা আমরা মনে করেছিলাম, একটি নিরপেক্ষ সরকার আমাদের একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। সেটা দিয়েও ছিল। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তা গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। কিন্তু আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনের পর আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু পারেনি। তাই আবারও প্রশ্ন উঠল দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন। আবার সংবিধান সংশোধন হল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হল। কিন্তু ওই নির্বাচন (দশম জাতীয় সংসদ) আমাদের জন্য কোনো সুখের বার্তা বয়ে আনেনি। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। আস্থাহীনতার সম্পর্ক এত ব্যাপক ও গভীর যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আবার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিএনপি যদি সত্যি সত্যিই নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচনের যে দাবি তা নিশ্চিত হবে কীভাবে?
নির্বাচন হতে এখনও বাকি ন’মাস। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সহায়ক সরকারের’ দাবি অসাংবিধানিক। এটাই সত্য। আর এ সত্যটা মেনেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। এ ছাড়া বিএনপির কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক পথেই যেতে হবে। পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে তা এখন বিএনপিকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। যদিও মির্জা ফখরুল বলেছেন, যারা মিছিল থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে তারা বহিরাগত। তারা যে সত্যি সত্যিই বহিরাগত তা বিএনপিকেই এখন প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির মিছিল থেকে যখন পুলিশের ওপর হামলা হয়, তখন বিএনপি এর দায় এড়াতে পারে না।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হওয়ার পরপরই রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিএনপিকে ‘পজিটিভ’ রাজনীতিতে আসতে হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায় যাই হোক না কেন, বিএনপিকে আইনি মোকাবেলা করেই আগামী নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। সেসব বক্তব্য নিয়েই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এটা সত্য বিএনপিকে কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করতে হবে। আর কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করেই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই একটি স্থিতিশীল রাজনীতি। চাই সন্ত্রাসমুক্ত রাজনীতি। সন্ত্রাসমুক্ত ও স্থিতিশীল রাজনীতিই পারে বাংলাদেশের জনগণকে একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে।
Daily Jugantor
03.02.2018
0 comments:
Post a Comment