এটা মোটামুটিভাবে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন কারা কারা পাচ্ছেন। নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত করে প্রার্থীদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে কিছু ‘জটিলতা’ এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু নৌকার প্রার্থী তালিকায় খুব বড় পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগ অনেকটা পুরনোদের ওপরই বেশি আস্থা রেখেছে। একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন ক্রিকেটার কিংবা বিতর্কিত এমপিদের কারো কারো স্ত্রী কিংবা বাবাকে মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ কি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? কিংবা রাজনীতিতে যে পরিবারতন্ত্র, সেই বৃত্ত থেকেও আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতিতে স্থানীয়ভাবে সেই পারিবারিক রাজনীতির ধারাই বহাল রাখল আওয়ামী লীগ। একটা প্রত্যাশা ছিল, আওয়ামী লীগ স্থানীয় পর্যায়ে তরুণ ও আধুনিক মনস্ক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এবার সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রার্থী তালিকা দেখে মনে হলো আওয়ামী লীগ সেই পুরনোদের ওপরই আস্থা রাখল। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টে নতুন করে যোগদানের হিড়িক, বিশেষ করে কয়েকজন পুরনো আওয়ামী লীগ নেতার, সাবেক মন্ত্রীর গণফোরামে যোগদান, সেনা কর্মকর্তাদের (অবসরপ্রাপ্ত) গণফোরামে যোগদানের বিষয়টি যতটুকু না রাজনৈতিক, তার চাইতে বেশি মাত্রায় সুবিধাবাদের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবান্বিত। এদের সবারই টার্গেট সংসদে যাওয়া, এমপি হওয়া! কিন্তু এতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু? যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের রজনীতিকে ‘বিষাক্ত’ করে তুলেছে, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব কি? রাজনীতিতে যে ‘আস্থা’র সম্পর্কটা থাকা জরুরি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না, সে প্রশ্ন থাকলই। তবে রাজনীতিতে সূক্ষ্মভাবে হলেও একটি পরিবর্তনের ‘ধারা’ সূচিত হতে যাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের জন্ম ও বিএনপি নেতাদের সেই নেতৃত্ব মেনে নেওয়া রাজনীতিতে নতুন একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতি চলমান বিদ্বেষমূলক রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারবে কি-না, সে প্রশ্ন এখন অনেকের। মানুষ চায় এই বিদ্বেষমূলক রাজনীতির অবসান। মানুষ চায় নতুন এক রাজনীতি। মানুষ চায় একটি শক্তিশালী সংসদ। সেই সংসদ আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন এখন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই একটা প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে— আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ কি নতুন এক রাজনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে? নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্রিত হয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে দেশে সংসদীয় রাজনীতির ধারা চালু করেছিল। কিন্তু সেই সংশোধনী সুখের হয়নি। সংসদীয় রাজনীতি আমরা চালু করেছিলাম বটে, কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ বয়কটের রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এক পর্যায়ে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ‘ছদ্ম সেনাশাসন’— অর্থাৎ পরোক্ষ সেনাশাসন, যেখানে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। সাধারণ মানুষ সেই ‘সেনাশাসন’কে গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আবারো রজনীতিবিদদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল দেশ পরিচালনা করার। ২০০৮ সালে ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন হয়েছিল বটে। কিন্তু ওই নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ (নবম) গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি, বরং দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ‘গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাত’-এর শামিল। একদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট, অন্যদিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা— এই ‘দ্বন্দ্বে’ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল এমন একটি নির্বাচন, যেখানে ১৫৩ প্রার্থী বিনাভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সেটা ছিল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সংসদ তার পাঁচ বছরের টার্মও পূরণ করতে যাচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনপরবর্তী যে সহিংসতা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের যে ‘দৃশ্য’ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। বরং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত প্রায় পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ‘হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টে বিএনপি মূলশক্তি হলেও, নেতৃত্বে নেই বিএনপি। নেতৃত্ব চলে গেছে অন্যদের হাতে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বিদেশনির্ভরতা এতটুকুও কমেনি। নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিদেশিরা।
স্পষ্টতই নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ভারত কিংবা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, আমরা বার বার আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছি। এটা ভালো নয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারের সব মন্ত্রীই এখন ক্ষমতায়। তারা পুলিশ প্রটেকশন নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছেন বটে, কিন্তু এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক বা কেন, ঐক্যফ্রন্টের উচিত ছিল সাংবিধানিক কাঠামোয় এর একটি ‘সমাধান’ বের করা। তারা তা করেনি। ঐক্যফ্রন্টের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অত শক্তিশালী নয়। তারা কোনো ফর্মুলা দিতে পারেনি। এমনকি সংলাপেও তারা একটি ফর্মুলা দিতে পারত। জাতি কোনো বিকল্প কিছু পায়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন। মন্ত্রীরা সবাই আছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে মন্ত্রিসভার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত। কিন্তু তা হয়নি। সংলাপ হয়েছে বটে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন ‘শূন্য ফলাফল’ নিয়েই ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। তবে একটা ভালো খবর— ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। এটাই সঠিক রাজনীতি। নির্বাচন বয়কট কোনো ‘রাজনীতি’ হতে পারে না। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু তা দলটির জন্য সুখের হয়নি।
এখন নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হচ্ছে। তবে এই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে আস্থার সম্পর্ক থাকা জরুরি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বার বার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করাও জরুরি। নয়া সরকার (২০১৯) বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি জাতীয় দৈনিক (প্রথম আলো ১৯ নভেম্বর)। অভিযোগ তোলা হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে। অথচ ইসি জানিয়েছে তারা পুলিশকে এই দায়িত্ব দেয়নি। এতে করে ইসির ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিগত সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযেগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। ওই নির্বাচনে (খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর) ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা রাজনীতির দৃশ্য মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল মিডিয়ার বদৌলতে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এইসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না- ইসি এটা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসি জাতিকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাই যেকোনো বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই বেগম জিয়া ও তারেক রহমান অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য ‘মাইনাস’ হয়ে গেলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় রাজনীতিও চলে গেল বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকলেও তাদের ভূমিকা এখন সীমিত হয়ে যাবে।
‘নতুন এক রাজনীতির যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে, তারাই গুরুত্ব দেবে সংসদীয় রাজনীতিকে। এক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি থেকেও বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন আছে নির্বাচনপরবর্তী রাজনীতি নিয়ে। সংসদীয় রাজনীতির মূলকথা হচ্ছে, বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে কি না, বলা কঠিন। নির্বাচনের আগে যে হারে ঐক্যফ্রন্ট তথা গণফোরামে সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থকদের যোগদানের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তাতে করে ব্যক্তির সুবিধাবাদী রাজনীতিই বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কাউকে কাউকে দেখা গেছে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নমিনেশন ‘আদায়’ করে নিয়েছেন। এতে করে বিএনপির রাজনীতিরই বা কতটুকু উন্নতি হবে, সে প্রশ্ন থাকলই।
এমপি হওয়ার এটা একটা সহজ সুযোগ। সারা জীবন স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও, এবার দেখা গেল দল-বদলের হিড়িক। নির্বাচন যেন অনেকটা এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতা! এই প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ী তথা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংখ্যাই বেশি। এদের দ্বারা রাজনীতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশের খবর ৩০ নভেম্বর ২০১৮
বাংলাদেশের খবর ৩০ নভেম্বর ২০১৮
0 comments:
Post a Comment