একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই একটা প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছে—বাংলাদেশ কি নতুন এক রাজনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে? নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্র হয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে দেশে সংসদীয় রাজনীতির ধারা চালু করেছিল। কিন্তু সেই সংশোধনী সুখের হয়নি। সংসদীয় রাজনীতি আমরা চালু করেছিলাম বটে; কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ বয়কটের রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। একপর্যায়ে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ‘ছদ্ম সেনা শাসন’, অর্থাৎ পরোক্ষ সেনা শাসন, যেখানে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেছে। সাধারণ মানুষ সেই ‘সেনা শাসন’কে গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আবারও রাজনীতিবিদদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল দেশ পরিচালনা করার। ২০০৮ সালে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন হয়েছিল বটে; কিন্তু ওই নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ (নবম) গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি, বরং দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ‘গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাত’-এর শামিল। একদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট, অন্যদিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা—এই ‘দ্বন্দ্বে’ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল এমন একটি নির্বাচন, যেখানে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা ভোটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সেটা ছিল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সংসদ তার পাঁচ বছরের টার্মও পূরণ করতে যাচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী যে সহিংসতা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের যে ‘দৃশ্য’ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। বরং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত প্রায় পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ‘হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টে বিএনপি মূল শক্তি হলেও নেতৃত্বে নেই বিএনপি। নেতৃত্ব চলে গেছে অন্যদের হাতে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বিদেশ-নির্ভরতা এতটুকুও কমেনি। নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিদেশিরা।
স্পষ্টতই নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ভারত কিংবা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে আমরা বারবার আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছি। এটা ভালো নয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারের সব মন্ত্রীই এখন ক্ষমতায়। তাঁরা পুলিশ প্রটেকশন নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছেন বটে। কিন্তু এর পেছনে যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, ঐক্যফ্রন্টের উচিত ছিল সাংবিধানিক কাঠামোয় এর একটি ‘সমাধান’ বের করা। তারা তা করেনি। ঐক্যফ্রন্টের থিংক ট্যাংক অত শক্তিশালী নয়। তাঁরা কোনো ফর্মুলা দিতে পারেননি। এমনকি সংলাপেও একটি ফর্মুলা আসতে পারত। জাতি কোনো বিকল্প কিছু পায়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন। মন্ত্রীরা সবাই আছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে মন্ত্রিসভার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত। কিন্তু তা হয়নি। সংলাপ হয়েছে বটে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন ‘শূন্য ফলাফল’ নিয়েই ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। তবে একটা ভালো খবর—ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। এটাই সঠিক রাজনীতি। নির্বাচন বয়কট কোনো ‘রাজনীতি’ হতে পারে না। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু তা দলটির জন্য সুখের হয়নি।
এখন নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হচ্ছে। তবে এই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করাও জরুরি। নয়া সরকার (২০১৯) বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি জাতীয় দৈনিক। অভিযোগ তোলা হয়েছে, নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে। অথচ ইসি জানিয়েছে, তারা পুলিশকে এই দায়িত্বটি দেয়নি। এতে করে ইসির ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিগত সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। এই নির্বাচনে (খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর) ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা রাজনীতির দৃশ্য মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল মিডিয়ার বদৌলতে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না—ইসি এটা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসি জাতিকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাই যেকোনো বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য ‘মাইনাস’ হয়ে গেলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় রাজনীতিও চলে গেল বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকলেও তাদের ভূমিকা এখন সীমিত হয়ে যাবে।
‘নতুন এক রাজনীতির যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে, তারাই গুরুত্ব দেবে সংসদীয় রাজনীতিকে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি থেকেও বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে। সংসদীয় রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। ব্রিটিশ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারেরই অংশ। অর্থাৎ সরকারকে সঠিক নীতিটি গ্রহণ করতে বিরোধী দল সাহায্য করে। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে প্রধান বিরোধী দল বিদেশে কখনোসখনো প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে এমনটি হওয়া উচিত। যারাই সরকার গঠন করবে, বিরোধী দলকে তাদের আস্থায় নিতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে কোথাও কোথাও বিরোধী দলকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বটি দিতে হবে। বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সংসদীয় রাজনীতিতে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। দশম জাতীয় সংসদ বেশি মাত্রায় এককেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় সেখানে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। দেশে সংসদীয় সচিবের পদ না থাকায় সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা অতি ক্ষমতাধর হয়ে পড়েছেন। মন্ত্রীরা জনপ্রতিনিধি হয়েও বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য যদি ‘পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি’ বা সংসদীয় সচিবের পদ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে গণতন্ত্র শুধু শক্তিশালীই হবে না, বরং অতি ক্ষমতাধর আমলাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমে যাবে। সচিবালয়ের আমলারা শুধু প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত থাকবেন। সংসদীয় সচিবরা আইন প্রণয়নে মন্ত্রীকে তথা সংসদকে সহযোগিতা করবেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন ও বিধি সংশোধন করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়োগ বা মনোনয়ন সংসদ কর্তৃক পরীক্ষিত বা স্ক্রুটিনির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ওই শীর্ষ ব্যক্তির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে সংসদই শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়োগ চূড়ান্ত করে। বর্তমান সংবিধানে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। যেমন—সংসদ রেখেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অস্পষ্টতা, কাগজ-কলমে ইসির ভূমিকা ইত্যাদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একধরনের অন্তরায়। প্রতি সংসদীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে পারে, যেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কমিশন সংবিধান সংশোধনের জন্য কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করবে। বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই সংসদে অনেক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের দেখা মিলবে, যাঁরা বিরোধী দলে থাকবেন। সংসদকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা হবে মুখ্য। তাঁরা ‘নতুন এক রাজনীতি’ উপহার দেবেন—এমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার যে রাজনীতি আমাদের চলমান রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ কারণেই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
0 comments:
Post a Comment