স্থানীয় পর্যায়ে যারা পার্টির হয়ে কাজ করেন, স্থানীয় জনগণের সুখে-দুঃখে যারা থাকেন, তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ব্যবসায়ী, অভিনেত্রী, সেনা কর্মকর্তাÑ সবাই এখন এমপি হতে
চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান
চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে দুটি বড় দলের নেতাকর্মীদের যে শোডাউন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে এটা আবারও স্পষ্ট হয়ে গেল, নির্বাচনে তথাকথিত দুটি বড় জোটের (১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) অস্তিত্ব থাকলেও বাহ্যত দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে এ নির্বাচন দুটি বড় দলের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশি এ কারণে, ৪০ বছরের ইতিহাসে দলটি এতবড় বিপর্যয়ের মুখে আর কখনও পড়েনি। দলটি এই প্রথমবারের মতো জিয়া পরিবারকে ‘মাইনাস’ করেই নির্বাচনি রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দলটির নেতৃত্ব কী শেষ পর্যন্ত জিয়া পরিবারের বাইরে চলে গেল, সেটা একটা ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন এখন। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনে অংশ নিতে ও রাজনীতির ময়দানে থাকতে দলটিকে এখন ড. কামাল হোসেনের মতো লোকের ‘আশ্রয়’ নিতে হলো, যিনি কোনোদিনই বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন করেননি। এটা বিএনপির মতো সংগঠনের জন্য ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, তা হয়তো আগামী দিনগুলোতে আমরা বিশ্লেষণ করব। তবে মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় বিএনপির অফিসের সম্মুখে যে জনমুদ্র আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে এটা আবারও প্রমাণিত হলো, সাধারণ মানুষের আস্থা এখনও বিএনপির প্রতি আছে। কিন্তু বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে আদৌ সাহায্য করবে? এটা একটা ওয়ান মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে দুটি বড় দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাসের পেছনে যুক্তি যে নেই, তা বলা যাবে না। যুক্তি আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হলেও অবিশ্বাসের রাজনীতির কারণে এ দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের দ্বিদলীয় ব্যবস্থা সেখানকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে।
এরই মধ্যে দুটি বড় দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ। যাদের নাম পত্রপত্রিকায় এসেছে, তাতে তো আমার অবাক হওয়ার পালা। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, একজন এক-এগারোর কুশীলব, একজন ক্রিকেটার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, পুলিশের সাবেক আইজিÑ সবাই এখন এমপি হতে চান! এতে অবিশ্যি নৌকার পাল্লাই ভারী। বিএনপি এখন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তাই বিএনপিতে তথাকথিত ভিআইপিদের ভিড় কম। তবে এটা বলতেই হবে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি।
তবে কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল কেন হলো? আমি মনে করি, বিএনপির এ সিদ্ধান্তটি সঠিক ও যৌক্তিক। কেননা বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, বিএনপি কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এটা বিএনপির ব্যর্থতা। যদিও সরকারের জুলুম, হামলা, মামলা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির কথা বলা হয়। এর পেছনে সত্যতা হয়তো আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি তেমন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী মঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিএনপির কোনো বিকল্প ছিল না। ড. কামাল একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার দল শক্তিশালী নয়, সংগঠন দুর্বল; কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ আছে। বিএনপি চেয়েছে এ ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে ‘বৈতরণী’ পার হতে। বিএনপির একটি ‘এক্সিট’ এর প্রয়োজন ছিল। খালেদা জিয়া জেলে। তারেক রহমান শাস্তিপ্রাপ্ত। নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে তিনি আপিল করতে পারবেন না। ফলে বিএনপি কৌশলগতভাবে এ দুই নেতাকে ‘মাইনাস’ করে ড. কামালের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলল। বিএনপির কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু তা-ই নয়, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না কিংবা আ স ম আবদুর রবÑ এরা কেউই অতীতে বিএনপির মিত্র ছিলেন না। বিএনপিকে এটা জেনেই তাদের সঙ্গে ঐক্য করতে হয়েছে। অনেকেই ‘মাহাথির মোহাম্মদ’-এর দৃষ্টান্ত দেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আনোয়ার ইবরাহিমের কাছে দায়িত্বভার অর্পণ করতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে তিনি এটা স্বীকারও করেছেন। এই ফর্মুলা বাংলাদেশে কাজ করবে না। ওবায়দুল কাদের আকার-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আইনগতভাবেই মুক্তি পাবেন অথবা চিকিৎসার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কিংবা তারেক রহমান কেউই অংশ নেবেন না। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে কামাল হোসেনই থেকে যাবেন। আর চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোর সম্পর্ক কী হবে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কাদের সিদ্দিকী কিংবা আ স ম আবদুর রব অতীতে তারেক রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন একাধিকবার। এরা সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছেন; কিন্তু তারেক রহমানের দ-াদেশ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এর অর্থ এরা তারেক রহমানের বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারেক রহমানই বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা। তাকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেÑ সেটা একটা প্রশ্ন। আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতারা খুব সুবিধা করতে পারবেন না। মূল নেতা কামাল হোসেনের বাইরে কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রাধান্য পাবেন বেশি। এক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস কিংবা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়রা কম প্রাধান্য পাবেন। এতে এক ধরনের অসন্তোষের জন্ম হতে পারে। নজরুল ইসলাম খান কিংবা ড. মঈন খানের মতো মডারেট নেতারাও গুরুত্ব পাচ্ছেন কম। এটা চোখে লাগার মতো। একটা বড় প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে। ঐক্যফ্রন্ট বলছে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে, ২০ দলের সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় ২০ দলের সিনিয়র নেতাদের, বিশেষ করে কর্নেল অলি আহমদ কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমকে দেখা যায় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শুধু জেনারেল ইবরাহিম উপস্থিত ছিলেন। অথচ এরা দুজন ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে এদের অবমূল্যায়ন করেছে কিংবা এদের অবদানকে ভুলে গেছে, এমন অভিযোগেও আছে। ফলে এদের ভূমিকা আগামীতে লক্ষ করার মতো। এটা অস্বীকার করা যাবে না, ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনি জোটে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে আসন বণ্টনের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ফ্রন্টে থেকে বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটের জন্য অধিক আসন দাবি করবে? নাকি ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর বাইরে অন্য কোনো দলের মাঝে আসন বণ্টন করবে না? ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো এখন অবধি ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেনি। ফলে সংগত কারণেই ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ওই দলগুলো আসন দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি ওই দলগুলোর এক ধরনের অসন্তোষ থেকে যাবে। জোটটি ভেঙে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি বড় ডিলেমা ‘ফেস’ করছেÑ একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অন্যদিকে ২০ দলীয় জোট। বিএনপি অগ্রাধিকার দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোট। উপরন্তু ঐক্যফ্রন্টে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপি ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে! বিএনপি বড় দল। তারা বেশি আসন চাইবেÑ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছোট ছোট দলগুলো যদি বেশি আসন চায়, যা এরই মধ্যে মান্নার কথার মাঝে ফুটে উঠেছে, এতে ঐক্যফ্রন্টে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। বিএনপির অনেক নেতা তখন ফ্রন্টের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারেন! বিএনপি ভেঙে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কোনো ‘পক্ষ’ কি সেটাই চাইছে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই তাতে। বিরোধী পক্ষের রাজনীতি এতে আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক।
মূল প্রশ্ন একটিÑ একটি আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের কয়েকটি দল যেভাবে এখনও ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। দুটি বড় দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক থাকতে হবে। না হলে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। বিগত বছরগুলোতে আমরা ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতি, বিরোধী পক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দান, মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) যে ‘চিত্র’ আমরা দেখেছি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা কেউ দেখতে চাই না। পেশিশক্তির নাম আর যাই হোক গণতন্ত্র নয়Ñ এ কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারির পরিস্থিতি এড়িয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে একটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার এখানে মুখ্য। কিন্তু পেশিশক্তির কাছে জনগণের ভোটাধিকার যেন পরাস্ত না হয়Ñ আমাদের প্রত্যাশা এটাই। আমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছে। এ সুযোগটি যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সরকার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু শুধু উন্নয়ন প্রক্রিয়া দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। গণতন্ত্রের স্থায়ী ভিত্তির জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এর প্রায় সবগুলোতেই ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যিনি কোনো দিন নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাননি, নিজের ব্যবসা কিংবা প্রফেশন নিয়ে যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় পার করেছেন, পরিণত বয়সে এসে তিনি এখন এমপি হতে চান। পার্লামেন্টে যেতে চান। এসব লোক দিয়ে জনগণের মঙ্গল আশা করা যায় না। এরা ‘শীতের পাখি’, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এদের আর নিজ এলাকায় কোনো দিন দেখাও যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ে যারা পার্টির হয়ে কাজ করেন, স্থানীয় জনগণের সুখে-দুঃখে যারা থাকেন, তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ব্যবসায়ী, অভিনেত্রী, সেনা কর্মকর্তাÑ সবাই এখন এমপি হতে চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে; কিন্তু এ নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কতটুকু শক্তিশালী করবেÑ সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। যতদিন পর্যন্ত না আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
তবে কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল কেন হলো? আমি মনে করি, বিএনপির এ সিদ্ধান্তটি সঠিক ও যৌক্তিক। কেননা বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, বিএনপি কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এটা বিএনপির ব্যর্থতা। যদিও সরকারের জুলুম, হামলা, মামলা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির কথা বলা হয়। এর পেছনে সত্যতা হয়তো আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি তেমন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী মঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিএনপির কোনো বিকল্প ছিল না। ড. কামাল একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার দল শক্তিশালী নয়, সংগঠন দুর্বল; কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ আছে। বিএনপি চেয়েছে এ ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে ‘বৈতরণী’ পার হতে। বিএনপির একটি ‘এক্সিট’ এর প্রয়োজন ছিল। খালেদা জিয়া জেলে। তারেক রহমান শাস্তিপ্রাপ্ত। নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে তিনি আপিল করতে পারবেন না। ফলে বিএনপি কৌশলগতভাবে এ দুই নেতাকে ‘মাইনাস’ করে ড. কামালের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলল। বিএনপির কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু তা-ই নয়, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না কিংবা আ স ম আবদুর রবÑ এরা কেউই অতীতে বিএনপির মিত্র ছিলেন না। বিএনপিকে এটা জেনেই তাদের সঙ্গে ঐক্য করতে হয়েছে। অনেকেই ‘মাহাথির মোহাম্মদ’-এর দৃষ্টান্ত দেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আনোয়ার ইবরাহিমের কাছে দায়িত্বভার অর্পণ করতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে তিনি এটা স্বীকারও করেছেন। এই ফর্মুলা বাংলাদেশে কাজ করবে না। ওবায়দুল কাদের আকার-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আইনগতভাবেই মুক্তি পাবেন অথবা চিকিৎসার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কিংবা তারেক রহমান কেউই অংশ নেবেন না। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে কামাল হোসেনই থেকে যাবেন। আর চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোর সম্পর্ক কী হবে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কাদের সিদ্দিকী কিংবা আ স ম আবদুর রব অতীতে তারেক রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন একাধিকবার। এরা সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছেন; কিন্তু তারেক রহমানের দ-াদেশ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এর অর্থ এরা তারেক রহমানের বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারেক রহমানই বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা। তাকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেÑ সেটা একটা প্রশ্ন। আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতারা খুব সুবিধা করতে পারবেন না। মূল নেতা কামাল হোসেনের বাইরে কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রাধান্য পাবেন বেশি। এক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস কিংবা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়রা কম প্রাধান্য পাবেন। এতে এক ধরনের অসন্তোষের জন্ম হতে পারে। নজরুল ইসলাম খান কিংবা ড. মঈন খানের মতো মডারেট নেতারাও গুরুত্ব পাচ্ছেন কম। এটা চোখে লাগার মতো। একটা বড় প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে। ঐক্যফ্রন্ট বলছে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে, ২০ দলের সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় ২০ দলের সিনিয়র নেতাদের, বিশেষ করে কর্নেল অলি আহমদ কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমকে দেখা যায় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শুধু জেনারেল ইবরাহিম উপস্থিত ছিলেন। অথচ এরা দুজন ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে এদের অবমূল্যায়ন করেছে কিংবা এদের অবদানকে ভুলে গেছে, এমন অভিযোগেও আছে। ফলে এদের ভূমিকা আগামীতে লক্ষ করার মতো। এটা অস্বীকার করা যাবে না, ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনি জোটে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে আসন বণ্টনের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ফ্রন্টে থেকে বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটের জন্য অধিক আসন দাবি করবে? নাকি ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর বাইরে অন্য কোনো দলের মাঝে আসন বণ্টন করবে না? ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো এখন অবধি ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেনি। ফলে সংগত কারণেই ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ওই দলগুলো আসন দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি ওই দলগুলোর এক ধরনের অসন্তোষ থেকে যাবে। জোটটি ভেঙে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি বড় ডিলেমা ‘ফেস’ করছেÑ একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অন্যদিকে ২০ দলীয় জোট। বিএনপি অগ্রাধিকার দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোট। উপরন্তু ঐক্যফ্রন্টে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপি ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে! বিএনপি বড় দল। তারা বেশি আসন চাইবেÑ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছোট ছোট দলগুলো যদি বেশি আসন চায়, যা এরই মধ্যে মান্নার কথার মাঝে ফুটে উঠেছে, এতে ঐক্যফ্রন্টে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। বিএনপির অনেক নেতা তখন ফ্রন্টের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারেন! বিএনপি ভেঙে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কোনো ‘পক্ষ’ কি সেটাই চাইছে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই তাতে। বিরোধী পক্ষের রাজনীতি এতে আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক।
মূল প্রশ্ন একটিÑ একটি আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের কয়েকটি দল যেভাবে এখনও ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। দুটি বড় দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক থাকতে হবে। না হলে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। বিগত বছরগুলোতে আমরা ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতি, বিরোধী পক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দান, মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) যে ‘চিত্র’ আমরা দেখেছি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা কেউ দেখতে চাই না। পেশিশক্তির নাম আর যাই হোক গণতন্ত্র নয়Ñ এ কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারির পরিস্থিতি এড়িয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে একটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার এখানে মুখ্য। কিন্তু পেশিশক্তির কাছে জনগণের ভোটাধিকার যেন পরাস্ত না হয়Ñ আমাদের প্রত্যাশা এটাই। আমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছে। এ সুযোগটি যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সরকার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু শুধু উন্নয়ন প্রক্রিয়া দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। গণতন্ত্রের স্থায়ী ভিত্তির জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এর প্রায় সবগুলোতেই ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যিনি কোনো দিন নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাননি, নিজের ব্যবসা কিংবা প্রফেশন নিয়ে যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় পার করেছেন, পরিণত বয়সে এসে তিনি এখন এমপি হতে চান। পার্লামেন্টে যেতে চান। এসব লোক দিয়ে জনগণের মঙ্গল আশা করা যায় না। এরা ‘শীতের পাখি’, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এদের আর নিজ এলাকায় কোনো দিন দেখাও যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ে যারা পার্টির হয়ে কাজ করেন, স্থানীয় জনগণের সুখে-দুঃখে যারা থাকেন, তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ব্যবসায়ী, অভিনেত্রী, সেনা কর্মকর্তাÑ সবাই এখন এমপি হতে চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে; কিন্তু এ নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কতটুকু শক্তিশালী করবেÑ সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। যতদিন পর্যন্ত না আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
0 comments:
Post a Comment