রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিতে হবে


তাইফুরের আত্মহত্যা ও শান্তার খোলা চিঠির পরও পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি এখনও বেশ আলোচিত। এ রকম অনেক তাইফুর আত্মহত্যা করে। এ রকম অনেক শান্তার খোলা চিঠিও ছাপা হয়। কিন্তু আলোচনা হয় কম। এই দুই ভাইবোনের 'কাহিনী' আলোচনা হচ্ছে নানা কারণে। শান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমার ছাত্রীতুল্য ও সহকর্মী। শান্তা তার ভাই তাইফুরের আত্মহত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাইফুর ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ছাত্র। অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল সে। কিন্তু মাস্টার্সে তার ফল খারাপ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়! হতাশা থেকে তাইফুর আত্মহত্যা করে। মাস্টার্সে তার ফলাফল খারাপের জন্য শান্তা দায়ী করেছে শিক্ষক রাজনীতিকে। সে যে প্রশ্নগুলো তুলেছে (মাস্টার্সে থিসিসের সুপারভাইজার না দেওয়া, ১০ নম্বরে শূন্য দেওয়া ইত্যাদি, ক্যাম্পাস লাইভ, ১৮ জানুয়ারি)- এই প্রশ্নগুলো কি অমূলক? আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, আমরা কি এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত নই? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী হচ্ছে, কারা সেখানে শিক্ষক হচ্ছেন, কীভাবে শিক্ষক হচ্ছেন- সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাবার। তরুণ প্রজন্ম আমাদের অহঙ্কার। এরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু একজন তরুণের যখন সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়, সে তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের আত্মহত্যা কখনই কাম্য নয়। আমরা তা প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু তাইফুররা যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে, আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে তা পীড়া দেয়। আমাকেও এক ধরনের হতাশায় পেয়ে যায়। এক ধরনের দুঃখবোধও কাজ করে আমার মাঝে। আমার শ্রেষ্ঠ ছাত্রটিকেও আমি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারিনি। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষক না হয়ে তারা কেউ কেউ এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পর্যন্ত করছে। এর অর্থ, তাদের মেধা ছিল। আমরা এই সমাজ বাংলাদেশে সেই মেধার মূল্যায়ন করতে পারিনি। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা আমার ব্যর্থতা। আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। এখন তো আমাদের যাওয়ার পালা। সময় তো কম কাটল না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। কিন্তু কী রেখে যাচ্ছি আমরা? কারা শিক্ষক হবেন? কারা আগামী দিনের তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করবেন? শিক্ষামন্ত্রী নতুন। তার উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা কী, আমি জানি না। কিন্তু যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবেন, তারা শিক্ষামন্ত্রীকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন কিনা, আমার তাতে সন্দেহ। তাইফুরের আত্মহত্যার পর একজন তানিয়ার লেখাও পত্রপত্রিকায় 'প্রতিক্রিয়া' হিসেবে ছাপা হয়েছে। তানিয়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেও তানিয়া ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেনি।

দুই.

তাইফুরের আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সম্মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে এসেছে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের প্রশ্নটিও। ভালো ছাত্রটি এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য একটা 'রাজনীতি' আছে। সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থ, দলীয় আনুগত্য, বিশেষ বিশেষ এবং ক্ষমতাবান শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক। ফলে যারা এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত করতে পারে না, তারা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা। ভালো ছাত্র হয়েও অনেকে আবার বিপথগামী হয়। শুনলে অবাক হবেন, শিক্ষক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট একক নীতিমালা কোথাও অনুসরণ করা হয় না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইউজিসি একটি নীতিমালা প্রয়োগ করলেও, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপত্তি জানিয়েছে। ফলে নীতিমালাটি বাস্তবায়িত হয়নি। এখন যা হয় তা হচ্ছে, উপাচার্য আর বিভাগের সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত (প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে)। এ ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য হলো আসল। আপনি যদি দল না করেন, তাহলে ভালো ছাত্র হয়েও আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না। ভালো ছাত্রটি সাধারণত কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকে না। অনেক সময় শুধু শিক্ষক হওয়ার জন্য তাকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করতে হয়। এই সখ্য তৈরি না হলে তার 'স্বপ্ন' স্বপ্নই থেকে যায়। একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকে বটে। কিন্তু যারা 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে থাকেন বা নিযুক্ত হন, তারা সবাই দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে তাদের 'যোগ্যতা' বড় বিষয় নয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ের 'বিশেষজ্ঞ প্যানেলে'র সদস্য মনোনীত হয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব? এই প্রশ্নটি উপাচার্যের কাছে আদৌ কোনো বিষয় বলে মনে হয়নি! এখন একজন প্রত্নতাত্ত্বিক কী করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করবেন? এ ধরনের অনিয়ম শত শত। কেউ প্রশ্ন করে না। কেননা দলীয় প্রশ্নটি এখানে বড়। শুধু তাই নয়, যিনি হয়তো পড়েছেন অর্থনীতি, তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অন্য বিভাগে। যিনি পড়েছেন লোকপ্রশাসনে, তিনি এখন উন্নয়ন অর্থনীতির শিক্ষক। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অনেক। কীভাবে বিভাগের কিছু ক্ষমতাবান শিক্ষক তাদের বা তার পছন্দের ছাত্র বা ছাত্রীকে অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে শিক্ষক বানান কিংবা একটি সিন্ডিকেট গঠন করে কীভাবে বিশেষ ছাত্রটিকে শিক্ষক বানানোর উদ্যোগ নেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের জানিয়েছিল টিআইবি। 

টিআইবির তদন্তে উঠে এসেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব অনিয়মের কথা। শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছিল টিআইবি। অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ! প্রভাষকের জন্য এক রেট আবার সহকারী অধ্যাপকের জন্য আরেক রেট। এই রেটের আবার বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে পার্থক্য আছে। টিআইবির ওই প্রতিবেদন দুদক বিবেচনায় নেয়নি। বিবেচনায় নিলে অনেক উপাচার্য ও ক্ষমতাবান শিক্ষকের দুর্নীতি উঠে আসত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দুদক অনেক ভালো কাজ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই যে অনিয়ম, তা যদি দুদক তদন্ত করত, আমি খুশি হতাম। এতে করে অন্তত শিক্ষক নিয়োগে 'টাকার খেলা' বন্ধ হতো। এটা বন্ধ না হলে এই প্রবণতা বাড়বে বৈ কমবে না।

তিন.

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করা দরকার। ইউজিসি যে নীতিমালা তৈরি করেছে, তা একুশ শতকের উপযোগী নয়। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টির মতো। হয়তো আগামীতে আরও হবে। এ ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা তৈরি করা দরকার, যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। একটা সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। সুতরাং নতুন একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার। শিক্ষামন্ত্রী নতুন। তিনি নিল্ফেম্নাক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারেন- ১. ইউজিসির অধীনে অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো একটি কমিশন গঠন করা, যার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চাহিদা জানাবে আর কমিশন সে মতে ব্যবস্থা নেবে। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে 'বিশেষজ্ঞ প্যানেল' নিযুক্ত হবে, যাতে করে প্যানেল সদস্যদের 'প্রভাবিত' করার কোনো সুযোগ না থাকে; ২. তিনটি পর্যায়ে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে- অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্ট, লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা এবং ডেমো ক্লাস। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য মার্ক নির্ধারিত থাকবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এক বছরের জন্য প্রার্থী অস্থায়ী নিয়োগপত্র পাবেন। এক বছরে তিনি একটি গবেষণাগ্রন্থ, আর্টিকেল প্রকাশ করবেন; ৩. পাস করার পরপরই কোনো প্রার্থী আবেদন করার যোগ্যতা রাখবেন না। তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে কোনো সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে নূ্যনতম এক বছর কাজ করবেন। অতঃপর যোগ্য হিসেবে আবেদন করতে পারবেন। শ্রীলংকায় এমনটি আছে আর ইউরোপে পিএইচডি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালাতেও পরিবর্তন প্রয়োজন। পদোন্নতির নীতিমালা স্বচ্ছ নয়। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া উচ্চ পর্যায়ে পদোন্নতি কাম্য নয়। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া এমনকি ভারতের মতো দেশেও চিন্তা করা যায় না। ইউরোপে শিক্ষকতায় প্রবেশের এন্ট্রি পয়েন্ট হচ্ছে পিএইচডি। একসময় ছিল, এর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন দেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নিজেরাই পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে। সুতরাং এন্ট্রি পয়েন্টে পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নিয়ে ইউজিসি একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। তাতে খুব যে সফলতা পাওয়া গেছে, তা বলা যাবে না। এতে করে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হয়নি। তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে একটি ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন, যে ফান্ড থেকে তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করার জন্য বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হবে। বেসরকারি সেক্টর থেকেও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর নামেও এই ফান্ডটির নামকরণ হতে পারে। এতে করে আমাদের তরুণ শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।


উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে ইউজিসির ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম বন্ধে ইউজিসির ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু বাড়েনি শিক্ষার মান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত 'সার্টিফিকেট বিতরণ' কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী একটি কমিশন গঠন করতে পারেন, যারা একটা নীতিমালা প্রণয়ন করবে। যে নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হবে।
দৈনিক সমকাল, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

0 comments:

Post a Comment