একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর। কিন্তু এরপর যে প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচিত তা হচ্ছে, নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি এখন কেমন হবে? বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎই-বা এখন কী? কিংবা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কেমন রাজনীতি জাতিকে উপহার দেবেন? কিছু শঙ্কা, কিছু প্রশ্ন তো আছেই! নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক হয়েছে। বিএনপিও ২০ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি জানিয়েছেন, বিএনপির নির্বাচিত সাংসদরা শপথও নেবেন না ও সংসদ অধিবেশনে যোগও দেবেন না। তারা তা দেননি। গণফোরামের নির্বাচিত দু'জন সাংসদও একই পথ অবলম্বন করেছেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তারা কি রাজনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবেন? কিংবা সংসদে না গেলে তাদের যে দাবি তিন মাসের মধ্যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন, তাতে কি সরকার রাজি হবে? প্রথমত, ঐক্যফ্রন্টের সাংসদরা দীর্ঘমেয়াদি সংসদ বয়কট করে থাকতে পারবেন না। কেননা সংবিধানের ৬৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ভোটে জয়ী হয়ে কেউ যদি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেন, তাহলে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পর তার আসনটি শূন্য হবে।' ফলে বিএনপি ও গণফোরামের সাংসদরা এই ঝুঁকি নেবেন না। পরে হলেও তারা সংসদে যাবেন এবং সংসদে ও সংসদের বাইরে থেকেই তারা তখন সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করবেন। দ্বিতীয়ত, এটা ঠিক, নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হয়েছে বটে; কিন্তু তা ছিল ত্রুটিযুক্ত। এমনটি হওয়া কাম্য ছিল না। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার ধারণা, নির্বাচনটি ত্রুটিমুক্তভাবে হলেও আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটই বিজয়ী হতো। সরকার যে বিশাল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে মানুষ খুশি। স্থানীয়ভাবে অতি উৎসাহী কিছু লোকের কারণে আমরা একটি ভালো নির্বাচন পেলাম না। ফলে 'দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়' বলে যারা দাবি তোলেন, তাদের দাবি শক্তিশালী হলো। তৃতীয়ত, তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে বলা হয় Generation Z,, ঐক্যফ্রন্ট তাদের সমর্থন পায়নি। বিশ্বব্যাপীই Generation Z একটা ফ্যাক্টর। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হলো না। বলা ভালো, যাদের জন্ম মধ্য নব্বই ও ২০০০ সালের মধ্যে, তাদেরকেই Generation Z বলা হয় (অন্যদিকে Generation Y-এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তারাই, যাদের জন্ম ১৯৮০-৯৪ সালের মধ্যে। আর Generation X হচ্ছে ১৯৬৫-৮০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা)। এখন নয়া সরকারকে এই Generation Z-কে 'অ্যাড্রেস' করতে হবে। চতুর্থত, আগামী ৫ বছর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি একসঙ্গে চলতে পারবে কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। বিএনপি প্রার্থীদের পরাজয় এখন বিএনপিকে এক ধরনের বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপির যেসব হেভিওয়েট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, তারা এখন ঐক্যফ্রন্ট গঠনে তাদের লাভ-লোকসান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে বিএনপি 'বড় বিজয়', অনেকটা 'মালদ্বীপ মডেলের' স্বপ্ন দেখেছিল! মালদ্বীপে গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হেরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এ রকম স্বপ্ন যারা দেখেছিলেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ফলে বিএনপির ভেতরে এই প্রশ্ন এখন শক্তিশালী হবে। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ব্যবধান বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি এখন বেশি গুরুত্ব দেবে ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিতে। পঞ্চমত, বিএনপির ভবিষ্যৎ এখন কী? বর্তমান সরকার ৫ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত থাকবে। এই সময়সীমায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা থাকবে না। খালেদা জিয়া জেলে থাকবেন এবং আমার ধারণা, খালেদা জিয়াও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নেবেন! একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি থেকে 'জিয়া পরিবার'-এর দৃশ্যমান 'মাইনাস' ঘটল! আগামীতে রাজনীতিতে খালেদা জিয়া কোনো বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেননা, খালেদা জিয়ার বয়স তখন গিয়ে দাঁড়াবে ৮০ ছুঁই ছুঁই। খালেদা জিয়া মওলানা ভাসানী নন যে, শেষ বয়সে এসে তিনি গর্জে উঠবেন। আগামী পার্লামেন্টেও (দ্বাদশ) খালেদা জিয়ার থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত। তিনি আসতে পারবেন না। এখন তিনি যেভাবে দল চালাচ্ছেন, সেভাবে আগামীতে তিনি দল চালাতে পারবেন বলে মনে হয় না। এর বাইরে বিএনপিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। মির্জা ফখরুল নিজে তার এলাকায় (ঠাকুরগাঁও) বিজয়ী হতে পারেননি। তিনি খালেদা জিয়ার সংসদীয় আসনে বগুড়া থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। দলে তার চেয়ে সিনিয়র নেতারা রয়েছেন। তার নেতৃত্ব তারা মানবেন না। একটি 'যৌথ নেতৃত্ব'-এর কথা বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু তা কাজ করবে না। বিএনপির এই সংকট অতীতের সব সংকটের চেয়ে বেশি। অতীতে বিএনপি একাধিকবার ভেঙেছে। কিন্তু জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেই বিএনপি 'বড়' হয়েছিল। দলটির জনসমর্থনও বেড়েছিল। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। উপরন্তু বিএনপি ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। সংসদ যদি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, আমি অবাক হবো না! উচ্চ আদালতের নির্দেশেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ভূমিকাও এখন বহুল আলোচিত। জাতীয় পার্টি ১৪ দলীয় জোটে না থাকলেও মহাজোটের শরিক। মহাজোটের ব্যানারেই তারা নির্বাচন করেছে। জাতীয় পার্টির মাঝে দুটি ধারা অনেকদিন থেকেই বহমান। একটি সরকারে যোগ দেওয়া, অপরটি বিরোধী দলে থাকা। দশম জাতীয় সংসদে বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি একটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে; অন্যদিকে সরকারেও যোগ দিয়েছে। একটি বড় দলের জন্য এটা কখনও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকার বেশি মাত্রায় এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আক্ষেপ করেছেন একাদশ জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায়। ঐক্যফ্রন্টের ৭ জনকে নিয়ে যেমন শক্তিশালী বিরোধী দল হয় না, ঠিক তেমনি জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকলেও তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অভিনন্দন শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটা সত্য, গত ক'বছরে তিনি যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, উন্নয়নকে তিনি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তাতে করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং ভোটারের মাঝে প্রভাব ফেলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে ছিল, ২০১৮ সালে সেখানে তা ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ২০১৯ সালে তা ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছবে। ওই সময় পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (২০১৯) ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (সূত্র- এডিবি, এশিয়ান টাইমস, ২ জানুয়ারি)। শেখ হাসিনার সময়সীমায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালের দিকে ছিল ১৬১০ ডলারের মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে তা ১৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়। দরিদ্রতা (২০১৭) ২৩.১ শতাংশ থেকে কমেছে ২১.৮ শতাংশে (২০১৮)। আর একই সময়সীমায় অতি দরিদ্রতা কমেছে ১২.১ শতাংশ থেকে ১১.৩ শতাংশে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি তা ভারতের অগ্রগতির চেয়ে অনেক বেশি। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে যেখানে ছিল ৪৩, সেখানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬-এ। আর স্কুলে উপস্থিতির হার বেড়েছে ১০ শতাংশ হারে। অবকাঠামো খাতে চীন থেকে ৪২ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের উন্নয়ন ক্রিয়াকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে। তবে চীনা ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। এসব দেশ চীনা ঋণ পরিশোধে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
নয়া সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিগত সরকারের আমলে অনেক মন্ত্রী তাদের দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিল। এখন একটি দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা চাই, যারা তাদের দক্ষতা ও মেধা দিয়ে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়রদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত। বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইটি তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মঞ্জুরি কমিশনে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার জন্ম দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, চলতি ২০১৯ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্র 'বাণিজ্যযুদ্ধ', যা আপাতত এক ধরনের 'স্ট্যাটাসকো' অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় খারাপের দিকে টান নিতে পারে এবং এতে করে বাংলাদেশের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যখন একটি নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখন নয়া সরকার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। তাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। রাজনীতি আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই যে কোনো বিবেচনায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে একটি 'আস্থা ও বিশ্বাসের' সম্পর্কে যাওয়া উচিত।
'আস্থা ও বিশ্বাস'-এর অপর নামই গণতন্ত্র। এটি না থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে। বিশ্ব বড় সংকটে আছে। এমতাবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে 'রাজনৈতিক সমঝোতা' হলে ক্ষতি কী? গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপিকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিলে তা প্রকারান্তরে সরকারেরই লাভ। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে দূরে ঠেলে দিলে তা জটিলতাই সৃষ্টি করবে মাত্র।
০৮ জানুয়ারি ২০১৯
নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অভিনন্দন শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটা সত্য, গত ক'বছরে তিনি যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, উন্নয়নকে তিনি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তাতে করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং ভোটারের মাঝে প্রভাব ফেলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে ছিল, ২০১৮ সালে সেখানে তা ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ২০১৯ সালে তা ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছবে। ওই সময় পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (২০১৯) ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (সূত্র- এডিবি, এশিয়ান টাইমস, ২ জানুয়ারি)। শেখ হাসিনার সময়সীমায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালের দিকে ছিল ১৬১০ ডলারের মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে তা ১৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়। দরিদ্রতা (২০১৭) ২৩.১ শতাংশ থেকে কমেছে ২১.৮ শতাংশে (২০১৮)। আর একই সময়সীমায় অতি দরিদ্রতা কমেছে ১২.১ শতাংশ থেকে ১১.৩ শতাংশে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি তা ভারতের অগ্রগতির চেয়ে অনেক বেশি। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে যেখানে ছিল ৪৩, সেখানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬-এ। আর স্কুলে উপস্থিতির হার বেড়েছে ১০ শতাংশ হারে। অবকাঠামো খাতে চীন থেকে ৪২ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের উন্নয়ন ক্রিয়াকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে। তবে চীনা ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। এসব দেশ চীনা ঋণ পরিশোধে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
নয়া সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিগত সরকারের আমলে অনেক মন্ত্রী তাদের দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিল। এখন একটি দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা চাই, যারা তাদের দক্ষতা ও মেধা দিয়ে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়রদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত। বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইটি তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মঞ্জুরি কমিশনে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার জন্ম দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, চলতি ২০১৯ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্র 'বাণিজ্যযুদ্ধ', যা আপাতত এক ধরনের 'স্ট্যাটাসকো' অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় খারাপের দিকে টান নিতে পারে এবং এতে করে বাংলাদেশের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যখন একটি নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখন নয়া সরকার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। তাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। রাজনীতি আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই যে কোনো বিবেচনায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে একটি 'আস্থা ও বিশ্বাসের' সম্পর্কে যাওয়া উচিত।
'আস্থা ও বিশ্বাস'-এর অপর নামই গণতন্ত্র। এটি না থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে। বিশ্ব বড় সংকটে আছে। এমতাবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে 'রাজনৈতিক সমঝোতা' হলে ক্ষতি কী? গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপিকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিলে তা প্রকারান্তরে সরকারেরই লাভ। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে দূরে ঠেলে দিলে তা জটিলতাই সৃষ্টি করবে মাত্র।
০৮ জানুয়ারি ২০১৯
0 comments:
Post a Comment