পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে গেল মাসে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারত সফর করে গেছেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন ভারত সফর করে গিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও ভারত সফর করলেন। ট্রাম্পের ভারত সফরের পরপরই করোনাভাইরাস ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্পের ভারত সফরের আগে যদি করোনাভাইরাসের খবর জানা যেত, তাহলে ট্রাম্প তার ভারত সফর স্থগিত করতেন। ট্রাম্পের ভারত সফরের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিকে তারা বলছেন ‘সংঘর্ষ হ্রাসকরণ’ চুক্তি। অর্থাৎ তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন রাজি হয়েছে তারা সংঘর্ষ হ্রাস করবে! তবে তা শর্তসাপেক্ষে। কোনো শান্তি চুক্তি তারা স্বাক্ষর করেনি। এমনকি এই চুক্তিকে শান্তি চুক্তিও বলা যাবে না। তবে ইতিমধ্যে এই চুক্তি নিয়ে নানা কথা উঠেছে। যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দীর্ঘ ৪২ বছর যাবত যে দেশটিতে যুদ্ধ চলছে, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে সেখানে যুদ্ধ বন্ধ হবে কি না? সেখানে একটি প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। একটি শিশু সেখানে জন্মের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ দেখছে। যুদ্ধের ভয়াবহতার তারা নীরব সাক্ষী। একটি সরকার সেখানে আছে বটে। কিন্তু কার্যত সেই সরকারের কর্মকা- কাবুলেই সীমাবদ্ধ। প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে তালেবানসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো। সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তি কতটুকু নিশ্চিত হবে, সে প্রশ্নটাই এখন বড়। কাকতালীয়ভাবে কি না জানি না, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো ট্রাম্পের ভারত সফরের পরপরই? তবে ট্রাম্পের এই সফর নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা।
ট্রাম্পের বহুল আলোচিত ভারত সফর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য নতুন একটি খবর আর তা হচ্ছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং পাকিস্তানে আসছেন আগামী জুন মাসে। বিশে^র দুই বড় শক্তির রাষ্ট্রপ্রধানদের উপমহাদেশ সফর এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দেবে। করোনাভাইরাসের কারণে চীন এখন বলতে গেলে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসেও চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ওপর রাজনৈতিক ‘চাপ’ বাড়ছে। চীনের অর্থনীতিও পড়েছে ঝুঁকির মুখে। এমনি এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের পাকিস্তান সফর যখন চূড়ান্ত করা হয়, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে চীন পাকিস্তানকে কত গুরুত্ব দিচ্ছে। ট্রাম্পের ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রত্যাশা পূরণ না হলেও, স্পষ্টতই মার্কিনি নীতি কিছুটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে। এই সফরে ভারত লাভবান না হলেও, লাভবান হয়েছেন ট্রাম্প ও মোদি। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে গেলেও, শেষ অবধি ‘ইমপিচমেন্ট’-এর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। প্রতিনিধি সভা তাকে ‘ইমপিচ’ করলেও সিনেট তাকে ‘ইমপিচ’ করেনি। ফলে নতুন এক উদ্যমে তিনি তার নির্বাচনী প্রচারকাজ শুরু করেছেন। এ ক্ষেত্রে ৫০ হাজার ভারতীয় আমেরিকান তার টার্গেট। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী এই আদি ভারতীয়দের সমর্থন তিনি নিশ্চিত করতে চান। এ কারণেই গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৯) টেক্সাসে প্রকাশ্যে মোদি তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় যে Howdi Modi অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে যোগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেই একই আদলে আহমেদাবাদের Moetera Stadium-এ আয়োজন করা হয়েছিল ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানের। মোদি তার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ‘নমস্তে’ বলে। উচ্চারণ ত্রুটি নিয়ে বিতর্কের মাঝে পড়লেও মোদি-ট্রাম্প কোলাকুলির দৃশ্য ছিল মোদির জন্য প্লাস পয়েন্ট। তার হিন্দুত্ববাদ নীতি যখন খোদ ভারতে বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তখন ট্রাম্পের এই সফর তার জন্য ছিল আশীর্বাদ। ট্রাম্পের সফর বিতর্কের সৃষ্টি করলেও, মোদি অত্যন্ত কৌশলে ট্রাম্পের সমর্থন নিশ্চিত করলেন। এই সমর্থন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এখন। ট্রাম্পের এই সফরের পরপরই ঘোষিত হয়েছে আগামী জুন মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং পাকিস্তান সফরে আসছেন। চীন পাকিস্তানকেও অস্ত্র সাহায্য করছে। ট্রাম্পের ভারত সফর ও জুনে শি চিনপিংয়ের পাকিস্তান সফর এবং এই দুই শক্তির উপমহাদেশে অস্ত্র বিক্রি নতুন করে এ অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকেও অন্যতম পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এরই মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘টিকফা’ চুক্তি করেছে। এখন ‘আকসা’ চুক্তি করতে চাচ্ছে। ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে কাজ করছে। তথাকথিত এই ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকবে না।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অংশীদার’। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে চীনের প্রভাবকে ক্ষুণ করতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার। ভারতকে ‘বড় দায়িত্ব’ দিয়ে এগিয়ে যেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্র আফগান সরকারকে বাদ দিয়েই চুক্তি করল তালেবানদের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র চায় তাদের সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্বার্থ রয়েছে, তা ভারতের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে জ¦ালানি সম্পদের বিশার রিজার্ভ এদিকে আগ্রহ ট্রাম্প প্রশাসনের। কিন্তু এ অঞ্চলে (উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান) ইসলামিক জঙ্গিবাদেরও জন্ম হয়েছে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য আরেক চিন্তার কারণ। সুতরাং আফগানিস্তান থেকে পরিপূর্ণভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্ভব নাও হতে পারে। তালেবানদের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু এই চুক্তিই সব নয়। বরং তালেবানদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করেই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্র কিরগিজস্তানের মানাস বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আরও দুটো বিষয় যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে ‘টোকেন’ উপস্থিতিতে উৎসাহিত করতে পারে। আফগানিস্তানের পশ্চিমে ইরান অবস্থিত এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের সঙ্গেও সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের। এই দুটো দেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। সিচতান বেলুচিস্তান ইরানের একটি প্রদেশ ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান সীমান্তে ইরানি এই প্রদেশটি অবস্থিত। এই প্রদেশে ইরানের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে একটি চক্র সক্রিয়। যারা ‘জুনদুল্লাহ’ নামে পরিচিত। ফলে সিচতান বেলুচিস্তানকে কেন্দ্র করে আগামী দিনে মার্কিন ট্র্যাজেডি রচিত হতে পারে। ফলে আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি পরিত্যাগ করবে এটা আমার মনে হয় না। আফগান প্রশ্নে পাকিস্তানও একটি ফ্যাক্টর। কেননা তালেবানদের উত্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে পাকিস্তান একটা বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আফগানিস্তানের অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে এমন অভিযোগ রয়েছে। হাক্কানি নেটওয়ার্ক এই সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এ কারণেই এই ‘সংঘর্ষ হ্রাসকরণ’ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে পাকিস্তানের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এশিয়া টাইমস তার এক প্রতিবেদনে (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০) মন্তব্য করেছে এভাবে ‘US-Taliban deal puts Pakistan in drivers seat’। পাকিস্তান মূল চালিকাশক্তি! আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ভারতের উভয়েরই স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় আফগানিস্তানে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানের একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিও ভারত ব্যবহার করে। ঘানি সরকারের সঙ্গেও মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ব্যাপারেও পাকিস্তানের স্বার্থ রয়েছে। জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে ঘানি সরকারকে চাপে রাখতে চায় পাকিস্তান। সুতরাং পাকিস্তান যদি না চায় তাহলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
দক্ষিণ এশিয়া আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এলো। ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি, পাকিস্তানের চীন থেকে অত্যাধুনিক বিমান কেনা, আফগানিস্তানে তথাকথিত একটি শান্তি চুক্তি এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি চলতি ২০২০ সালটি অনেকের কাছেই তাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে। ট্রাম্প নভেম্বরে তার বিজয়কে যদি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে এ অঞ্চল তথা উপসাগরীয় অঞ্চলে একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেবে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে। ইতিমধ্যে ইসরায়েলে নির্বাচনে কট্টরপন্থি নেতানিয়াহু বিজয়ী হয়েছেন। তার এই বিজয় ইরানকে কেন্দ্র করে ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিল।Desh Rupantor
15.03.2020
0 comments:
Post a Comment