রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংক্রমিত বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ

I

রোনাভাইরাস

 

করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বোধকরি বিশ্ব এত বড় সংকটের মুখে আর পড়েনি। করোনা পরিস্থিতি চীনে যখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে, ঠিক তখনই 'লক-ডাউন' হয়ে গেছে ইউরোপের অনেক দেশ। এই পরিস্থিতির সঙ্গে নাইন-ইলেভেন পরিস্থিতি কিছুটা মিল থাকলেও বর্তমান সংকট একটা ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানানো হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ১৫৮টি দেশে কভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশই কভিড-১৯ ঠেকাতে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে, আরব আমিরাতের সব মসজিদের নামাজ চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রতি ওয়াক্তের আজান হবে। প্রতিটি গালফ স্টেটে মসজিদে নামাজ আদায় আপাতত নিরুৎসাহিত করা হয়েছে (আলজাজিরা)। সৌদি আরব ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের ভয়ে বিদেশিদের ওমরাহ হজ পালন নিষিদ্ধ করেছে। সৌদি আরবের মসজিদ আল হারাম, মসজিদে নববিতে নামাজ আদায়ও নিষিদ্ধ হয়েছে (মেইল অনলাইন)। ফ্রান্সেও মসজিদে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ হয়েছে (আরব নিউজ)। ফিলিস্তিনে বিখ্যাত আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশেও মসজিদে নামাজ আদায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির গভীরতা কতটুকু, তা ওপরে উল্লিখিত সংবাদগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায়।

অনেক দেশে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিমানবন্দরে এখন আর ইউরোপ থেকে কোনো বিমান অবতরণ করতে পারছে না। এরপরও যেসব যাত্রী অন্য দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন, তাদেরকে দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন যাত্রীকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বোঝাই যায়, পরিস্থিতি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এটা এক ধরনের 'স্বাস্থ্যযুদ্ধ'। বিশ্ব এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি কখনও। এই স্বাস্থ্যযুদ্ধ মোকাবিলা করার মতো মারণাস্ত্র এখন পর্যন্ত মানবসভ্যতা আবিস্কার করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ইনজেকশন আবিস্কার ও তা মানুষের শরীরে পুশ করার দৃশ্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও নিশ্চিত নই, তা করোনা প্রতিরোধে কতটুকু সফল হবে।

ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে এনেছে করোনাভাইরাস। কয়েকটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ করোনাভাইরাসের ভয়ে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়েছেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে পরীক্ষা করিয়েছেন। তবে তার শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব হোম কোয়ারেন্টাইনে গেছেন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। অতীতে এ ধরনের ভাইরাসে যত বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, তার একটি তথ্য দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯১৮-২০ সালে স্প্যানিস ফ্লুতে মারা গিয়েছিল ১০ কোটি মানুষ, ১৯৮১-২০১৭ এইচআইভিতে চার কোটি, ২০০২ সালে সার্সে ৭৭৪ জন, ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লুতে ২,৮৪,৫০০ জন, ২০১৩-১৬ সালে এভিয়ান ফ্লুতে ২৯৫ জন, ২০১৪-১৬ সালে ইবোলা ভাইরাসে ১১,৩২৫ জন। করোনাভাইরাসে ইতোমধ্যে ৭৫১৮ জনের মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে। এই মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা এই মুহূর্তে তা বলতে পারছি না। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা এর প্রভাবটা হয়তো তেমন একটা উপলব্ধি করতে পারব না; কিন্তু ৫-৬ মাস পর বিপর্যয়টা ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট হবে।

ব্লুমবার্গের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সংস্থাটির মতে, চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ১ দশমিক ২ ভাগে। ব্লুমবার্গের গবেষণায় দেখা গেছে, যেহেতু সারাবিশ্ব চীনের পণ্য, কাঁচামাল আর প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু চীনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় চীনের সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হবে। এতে করে চীনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। পাঠকদের একটু পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই।
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমে গিয়েছিল; যার কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার। সার্সের উৎপত্তিও চীনে। ওই সময় চীনের অর্থনীতি ছিল বিশ্ব জিডিপির ৪ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে এর হার ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। করোনাভাইরাসের আগে চীনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৬ ভাগ। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক কমে যাবে, ৫ ভাগেরও নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে অবধারিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। বিশ্ব ধীরে ধীরে এক বড় ধরনের মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মন্দা থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সে ব্যাপারে শঙ্কিত সবাই। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, চীনে এখন আর করোনাভাইরাসে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। চীন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। চীন এখন তার বিশেষজ্ঞদের ইতালি পাঠিয়েছে। স্পেনে পাঠিয়েছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট।

বাংলাদেশেরও দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে অনেক। বুধবার প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস আক্রান্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ। পোশাক খাতের ৬ শতাংশ রপ্তানি হয় ইউরোপে। কিন্তু সেখানে মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় তৈরি পোশাকের কোনো চাহিদা নেই। ফলে আরএমজির অর্ডার বাতিল হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে অসন্তোষ বাড়তে পারে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণ পরিস্থিতি কঠিন হবে। অনেক দেশের পক্ষেই নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এ থেকে বাইরে নয়। একটা আশঙ্কা হচ্ছে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ ছেড়ে বিনিয়োগ চলে যাবে অন্য দেশে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উপরন্তু চীন বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী। চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্নথগতি আসতে পারে। অনেক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে পর্যটন। এ খাতে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভয়টা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হবে। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার কালচার বাংলাদেশে রয়েছে। এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে ঋণখেলাপি হবে। ফলে ব্যাংকি খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে।

এখন করণীয় কী? এক. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যারা কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন; দুই. স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা জরুরি। এখানে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এই খাতের দুর্নীতি বহুল আলোচিত। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে। সরকার এই খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না।

কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা অত্যাধুনিক মেশিন বছরের পর বছর বাক্সবন্দি থাকছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে- এ খবর প্রায়ই ছাপা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অতি ক্ষমতাধর হওয়ায় আমরা তাদের শাস্তি দিতে পারিনি। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে অর্থের পরিমাণ বাড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে এই খাতে দুর্নীতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে; তিন. আইইডিসিআরের মতো (যেখানে একমাত্র করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা সম্ভব) আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে ও নিয়োগ দিতে হবে; চার. মেডিকেল কলেজগুলোতে 'ভাইরোলজি' বিভাগটি একরকম উপেক্ষিত বলেই মনে হয়। এই বিভাগে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে; পাঁচ. দেশে মহামারি রোগ আইন চালু করা জরুরি।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৮৯৭ সালের 'দ্য এপিডেমিক ডিজিজেস অ্যাক্ট' বা মহামারি রোগ আইন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই আইনবলে- ১. করোনা সন্দেহভাজন ভর্তি হতে না চাইলে বলপূর্বক ভর্তি করানো; ২. সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা; ৩. রোগী করোনাকবলিত দেশ থেকে এলে রিপোর্ট করা; ৪. স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও এমন আইন করা জরুরি এ কারণে যে- সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, যারা ইতালি থেকে এসেছেন, তারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সরকার যে কোনো সমাবেশ বা জমায়েতকে নিরুৎসাহিত করলেও জমায়েত হচ্ছে, যেখানে শত শত লোকের উপস্থিতি আছে। নির্বাচনও হচ্ছে। প্রচারও হচ্ছে, যেখানে শত শত লোকের জমায়েত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশ্ব করোনাভাইরাস নিয়ে একটা উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতনতা খুব একটা বৃদ্ধি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।Kalerkontho

1 comments:

  1. মোবাইল হতে আপনার ব্লগের লেখা পড়তে অসুবিধা হয়। লেখাগুলো সম্পূর্ণ আসে না।

    ReplyDelete