শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তাই সত্যে পরিণত হলো। বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ 'করোনা যুগে' প্রবেশ করল। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ ৯০টির অধিক দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এই করোনাভাইরাস শুধু যে স্বার্থ ঝুঁকিই তৈরি করবে তেমনটি নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এডিবি বলছে, এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির মোট ক্ষতি হবে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বাংলাদেশের জিডিপি কমবে দশমিক ০১ শতাংশের মতো- এমন ভবিষ্যদ্বাণী এডিবির। এই সংস্থাটির মতে, করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। করোনাভাইরাস যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা সত্যিকার অর্থেই বলা কঠিন।
আমাদের জন্য চিন্তার কারণ এটাই। বিশ্বব্যবস্থা যে আজ কত বড় ঝুঁকির মুখে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এর বড় প্রমাণ। আমরা এটাকে বলছি অপ্রচলিত নিরাপত্তা ঝুঁকি। নিরাপত্তার ধারণা ব্যাপক। একসময় পারমাণবিক শক্তিকে নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হতো। যে কারণে দেখা যায় বিংশ শতাব্দীতে শক্তিধর দেশগুলো কখনও চায়নি, অন্য কোনো দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক। কেননা তারা মনে করত, নিউক্লিয়ার ক্লাবের বাইরে কোনো দেশ যদি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে তা তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই নিরাপত্তা ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই এই নিরাপত্তা ধারণায় পরিবর্তন আসতে থাকে। তখন 'মানবিক নিরাপত্তা'র বিষয়টি সামনে চলে আসে এবং মানবিক নিরাপত্তাকে নিরাপত্তা ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিককালে নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রাধান্য পেয়েছে পরিবেশগত সমস্যাটি। অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) উত্তোলন ও ব্যবহারের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের পরিবেশগত সমস্যা। পরিবেশগত সমস্যা কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্বসম্প্রদায় একটি চুক্তিতে (কপ-২১) উপনীত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে ওই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ফলে পরিবেশগত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। আর এতে করে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। অর্থাৎ বাংলাদেশ কোনোভাবেই এই সমস্যার জন্য দায়ী নয়। এখন পরিবেশগত সমস্যার পাশাপাশি যুক্ত হলো করোনাভাইরাসের প্রসঙ্গটি অর্থাৎ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ঝুঁকি।
পাঠক, প্লেগ মহামারি কিংবা ইবোলা মহামারির কথা কি স্মরণ করতে পারেন? ইতিহাসে আছে প্লেগ মহামারির কথা, যা চিহ্নিত হয়ে আছে 'ব্ল্যাক ডেথ' হিসেবে। এই ব্ল্যাক ডেথ ইউরো-এশিয়া জোনে ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সময়টা ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ ইং সাল পর্যন্ত। ওই সময় প্লেগ রোগ প্রতিরোধের তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি- এটা স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের মতো দেশে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা আমরা জানি। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল ১৯৯৪ সালে। যদিও তাতে ব্যাপক মৃত্যুর খবর আমরা পাইনি। মাত্র ছয় বছর আগের কথা। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা নামে একটি মহামারি রোগ সেখানে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার মনে আছে, আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে। গিয়েদাতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে যা খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশেষজ্ঞ ওই এলাকায় গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সেখানেই ইবোলাতে আক্রান্ত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে মারা যান। তার ফিরে আসার পর ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। কয়েক হাজার মানুষ ইবোলাতে মারা গিয়েছিল। আরেকটি ভয়াবহ রোগ সার্স। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল ২০০২ সালের নভেম্বরে। এই রোগের উৎপত্তি ছিল চীনের ওয়ানদংয়ে। এটা এক ধরনের ফ্লু। খুব দ্রুত এই রোগটি ওয়ানদং থেকে সাংহাই ও বেইজিংয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই সময়। সেখান থেকে ছড়িয়ে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। এই রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছিল। ট্যুরিজম ব্যবসায় ধস নেমেছিল। ধস নেমেছিল রপ্তানি খাতেও। ওই সময় চীনের প্রবৃদ্ধি ১-২ ভাগ কমে গিয়েছিল আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমেছিল ০.৫ ভাগ। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেটার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট আমাদের জানাচ্ছে, সার্সের কারণে ওই সময় চীনের ক্ষতি হয়েছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার আর অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, এতে করে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল ৩০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দেশটি। যদিও এই মুহূর্তে এটা বলা যাচ্ছে না, কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে দেশটি! অনেক দেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা এসেছে। চীন থেকে ওই সব দেশে কাঁচামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না, যেমন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কাঁচামালের জন্য ব্যবসায়ীরা চীনের ওপর নির্ভরশীল। এখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিকল্প খুঁজছেন। চীনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও ধস নেমেছে। অনেক শহর এখন জনশূন্য। মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতে পারছে না। ছবিও ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, রাস্তাঘাট পরিত্যক্ত। এই পরিস্থিতি থেকে চীন কবে নাগাদ বের হয়ে আসতে পারবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে চীনের অর্থনীতি যে এর মধ্য দিয়ে বড় বিপদে পড়ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনাভাইরাসের কারণে চীনের মহাপরিকল্পনা 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড'-এর আওতায় বিভিন্ন দেশকে চীন যে ঋণ দেয়, তা এখন বাধাগ্রস্ত হবে। ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা আসবে। চীন থেকে মানুষের চলাচল কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে চীনে যাতায়াত এখন কমে এসেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চীনের রপ্তানি, সেই সঙ্গে চীনের অর্থনীতি। চীনা বিশেষজ্ঞদের এখন বিদেশে যাতায়াত সীমিত হয়ে আসছে। অনেক দেশ এখন চীনা বিশেষজ্ঞদের 'গ্রহণ' করতে এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকবে। এখানে আরও একটি বিষয়-সার্স কিংবা করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে চীন। পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে কম। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। ১৪.১৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি চীনকে শুধু বিশ্ব আসরে তার অবস্থানকেই (বিশ্বে দ্বিতীয়) শক্তিশালী করেনি বরং বিশ্বে চীনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। চীন প্রযুক্তি খাতে অনেক উন্নয়ন সাধন করেছে। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক না কেন, এই রোগ নির্ণয়, এ খাতে গবেষণা, রোগ নির্মূলে কার্যকর ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে চীন পিছিয়ে আছে- এটা বলতেই হবে।
তখন চীন এদিকে দৃষ্টি দেবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
করোনাভাইরাস যে শুধু চীনেই একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করল, তেমনটি নয়। বরং তা বিশ্ব ব্যবস্থায়ও আঘাত হেনেছে। করোনাভাইরাস প্রমাণ করল, পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার চেয়ে এই ভাইরাসের ঝুঁকি কম নয়। আমরা এটাকেই বলছি অপ্রচলিত নিরাপত্তা ঝুঁকি। প্রচলিত নিরাপত্তা ঝুঁকির চেয়েও এই ঝুঁকি অনেক বেশি। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে, যা দশ হাজারে উন্নীত হবে বলে আমার ধারণা। সার্স (২০০২-২০০৩), মের্স (২০১২), ইবোলা (২০১৪), এইচ ওয়ান এনওয়ান (২০০৯), ফ্লু ও জিকা ভাইরাসে (২০১৫) আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ১০ থেকে ৪০ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। ফলে ধারণা করছি, আমরা আগামীতে এ ধরনের অনেক নতুন মহামারি রোগের সংস্পর্শে আসব। এ ধরনের অনেক রোগ, যার প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি, আমাদের জননিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ প্রচুর জনসংখ্যাধিক্য দেশ। এখানে যে কোনো ধরনের মহামারি আমাদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাবে। চীন করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র যা করতে পেরেছে, আমরা তা পারব বলে মনে হয় না। আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালও আমাদের নেই। নেই ওষুধও। ফলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির এই দেশটির নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবেই। তবে এটা ঠিক, একটা জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে এর ভয়াবহতা। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। বিদেশি অতিথিরাও আসছেন না। পুরো অনুষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তবে আরও কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। বিমানবন্দরগুলোতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য যেসব থার্মাল স্ক্যানার রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। ইতালি থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ কভিড-১৯-এর জীবাণু বহন করে থাকতে পারেন, যা থার্মাল স্ক্যানারে ধরা পড়েনি। চীনের পর ইতালিতেই সবচেয়ে বেশি রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং বিদেশ থেকে যারাই আসছেন, তাদেরকে দ্রুত কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া ও পরীক্ষা করাটা জরুরি। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ানো প্রয়োজন। আইসিডিডিআর,বির মতো আরও কয়েকটি গবেষণাগার তৈরি করা দরকার। সরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি। সেই সঙ্গে চিকিৎসা কর্মীদের প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ নিতে পারে এ ব্যাপারে। আরও একটি কথা- জনসমাগম বা জমায়েত এড়িয়ে চলা এবং গণপরিবহন চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা প্রয়োজন। উহানে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছিল, তা আমরা অনুসরণ করতে পারি। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তাই জনসচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।Daily Samokal
10.03.2020
0 comments:
Post a Comment