রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনা ভাইরাস বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে








করোনা ভাইরাস, যার বৈজ্ঞানিক নাম কোভিড-১৯, একটি মহামারীতে রূপ নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্বের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এই চার মাসে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৫৬টি দেশে। আক্রান্তের খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০১ জন (১৬ মার্চ পর্যন্ত)। মৃতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৬ হাজার ৬৮ জন। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই।
একটি মরণঘাতী ভাইরাস যখন ১৫৬ দেশে ছড়িয়ে যায়, তখন কত বড় বিপর্যয় যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এ মুহূর্তের বিশ্বের দিকে যদি তাকাই, তা হলে মহাবিপর্যয়টা আমরা উপলব্ধি করতে পারব কিছুটা হলেও। যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউরোপ তথা এশিয়া থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ইউরোপ থেকে কোনো বিমান যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যত্র বেরিয়ে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা এই মহামারীর ব্যাপারে খুব যে একটা কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করতে পেরেছি, তা মনে হয় না। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং করছেন। আপডেট জানাচ্ছেন। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে, সন্দেহ নেই তাতে।
কিন্তু হোম ‘কোয়ারেনটিন’-এর কথা তিনি মুখে বলছেন বটে, কিন্তু এটা কার্যকরী হচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ নেই। এক ধরনের শৈথিল্য রয়েছে, যারা হুকুম পালন করার কথা, তাদের উপলব্ধিতে বিষয়টি নেই। করোনা ভাইরাসের ক্ষতির ঝুঁকি যে কত, তা তারা বোঝেন বলে মনে হয় না। আমরা হোম কোয়ারেনটিনের কথা বলছি বটে, কিন্তু দেখা গেল কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও জামালপুরে যারা সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তারা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসব করছেন।
নিত্যদিন স্থানীয় বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশছেন। এটা করে তারা যে কত বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন, তা তারা নিজেরা বুঝছেন না, কেউ তাদের বোঝাচ্ছেনও না। যারা ইতালি থেকে এসেছেন, তাদের একটা অংশকে ‘কোয়ারেনটিন’-এ রাখা হচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু একটা অংশ তো বাড়িতে চলে গেছেন। তাদের মনিটর করছে কে? শুধু প্রেস ব্রিফিং করে কী এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে? চীনের পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর আমরা পাচ্ছি ইতালি থেকে। তা এখন ছড়িয়ে গেছে স্পেনে। অথচ এই ইতালি থেকেই বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসছেন।
আমরা ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসা সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছি বটে, কিন্তু কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। সরকার গণজমায়েতকে নিরুৎসাহিত করছে। এ ক্ষেত্রে গণযাতায়াত ব্যবস্থায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা জরুরি। প্রয়োজন ছাড়া জনসাধারণের মুভমেন্টে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে অনেক শিক্ষার্থীর জমায়েত হয়, সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম আপতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে আমাদের নিত্যদিনের পরিবেশ। বিদেশে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, মানুষ এখন বাসাবাড়িতে থেকে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ‘ওয়ার্ক কালচার’ শুরু হয়েছে। এতে প্রচুর মানুষের এক সঙ্গে উপস্থিতি কমানো যায় এবং তাতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করা যায়। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমরাও এ দিকটার দিকে নজর দিতে পারি।
অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এ পদ্ধতির সম্ভাবনা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। দেশে বসে বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে, আমাদের জন্যও এটা একটা সুযোগ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু বিষয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা এর প্রভাবটা হয়তো তেমন একটা উপলব্ধি করতে পারব না, কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট হবে। ব্লুমবার্গের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। সংস্থাটির মতে, চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ১ দশমিক ২ শতাংশে।
ব্লুমবার্গের গবেষণায় দেখা গেছে, যেহেতু সারাবিশ্ব চীনের পণ্য, কাঁচামাল আর প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু চীনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় চীনের সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হবে। এতে চীনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। স্পেন ও জার্মানিতে মাইনাস শূন্য দশমিক ১, কানাডায় মাইনাস শূন্য দশমিক ১, জাপানে মাইনাস শূন্য দশমিক ১, দক্ষিণ কোরিয়া মাইনাস শূন্য দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়ার মাইনাস শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তা হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। পাঠকদের একটু পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই। ২০০৩ সালের SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) ভাইরাসের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১ ভাগ কমে গিয়েছিল, যার কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার। ঝঅজঝ-এর উৎপত্তি চীনে। ওই সময় চীনের অর্থনীতি ছিল বিশ্ব জিডিপির ৪ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে এর পরিমাণ ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনা ভাইরাসের আগে চীনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৬ শতাংশ।
কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক কমে যাবে, ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে অবধারিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। বিশ্ব ধীরে ধীরে এক বড় ধরনের মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মন্দা থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সে ব্যাপারে শঙ্কিত সবাই। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, চীনে এখন আর করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। চীন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। চীন এখন তার বিশেষজ্ঞদের ইতালি পাঠিয়েছে।
অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, আমাদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আমরা সেভাবে আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে অনেকগুলো। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপে। পোশাক খাতের ৬৫ শতাংশ রপ্তানি হয় ইউরোপে। কিন্তু সেখানে মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় তৈরি পোশাকের কোনো চাহিদা নেই। ফলে আরএমজির অর্ডার বাতিল হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিক ছাঁটাই হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে অসন্তোষ বাড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংক বলছে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ঋণ পরিস্থিতি কঠিন হবে। অনেক দেশের পক্ষেই নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এ থেকে বাইরে নয়।
তৃতীয়ত, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশ ছেড়ে বিনিয়োগ চলে যাবে অন্য দেশে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উপরন্তু চীন বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী। চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্লথগতি আসতে পারে। অনেকগুলো খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার মাঝে একটি হচ্ছে পর্যটন। এ খাতে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চতুর্থত, করোনা ভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হবে। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার কালচার বাংলাদেশে রয়েছে। এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে ঋণখেলাপি হবে! ফলে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। ফলে করণীয় কী? প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘নিরাপত্তা কাউন্সিল’-এর কার্যক্রম দৃশ্যমান করা। সেখানে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যারা কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা জরুরি। এখানে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি বহুল আলোচিত।
কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে। সরকার এ খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা অত্যাধুনিক মেশিন বছরের পর বছর বাক্সবন্দি থাকছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে-এ খবর প্রায়ই ছাপা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অতি ক্ষমতাধর হওয়ায় আমরা তাদের শাস্তি দিতে পারিনি। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে অর্থের পরিমাণ বাড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে এ খাতে দুর্নীতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। আইইডিসিআরের মতো (যেখানে একমাত্র করোনা ভাইরাসের ওপর গবেষণা ও চিকিৎসা সম্ভব) আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভাগীয় শহরগুলোয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে ও নিয়োগ দিতে হবে। মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ‘ভাইরোলজি’ বিভাগটি এক রকম উপেক্ষিত বলেই মনে হয়। সারাবিশ্বই ভাইরাসজনিত রোগ নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
২০০১ সালে অ্যানথ্রাকস, ২০০২ সালের ওয়েস্ট নীল ভাইরাস, ২০০৩ সালে সার্স, ২০০৫ সালে বার্ড ফ্লু, ২০০৬ সালে ইকোলি, ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১৪ সালে ইবোলা, ২০১৬ সালে জিকা ভাইরাস আর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের মহামারী আমাদের জানান দিয়ে গেল আমরা কী ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছি! এই নিরাপত্তাঝুঁকি পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়েও বেশি। সুতরাং আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন, আমাদের স্বস্তির জায়গাটা সেখানেই।
আইএমএফ এরই মাঝে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সহযোগিতা ঘোষণা করেছে। আমরা কীভাবে এই সহযোগিতা নিতে পারি, তা ভেবে দেখতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানিয়েছেন, চীন কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) চিকিৎসায় বিশ্বের সব দেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চীনের দক্ষতা প্রমাণিত। আমরা এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারি। চীনা বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে এনে আমাদের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, অথবা বিশেষজ্ঞ তরুণ চিকিৎসকদের চীনে পাঠানো যায়। করোনা ভাইরাসের ঘটনা আমাদের জন্য একটা ‘ওয়েক-আপ’ কল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই
Amader Somoy
19.03.2020

0 comments:

Post a Comment