সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে একাধিক সংবাদের জন্ম হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সংস্থা স্পুটনিক (Sputnik) আমাদের জানাচ্ছে, ভারত সাফল্যের সঙ্গে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ওড়িশা রাজ্যের বালাসোরে অবস্থিত আবুল কালাম দ্বীপের ক্ষেপণাস্ত্রঘাঁটি থেকে এই পরীক্ষা চালানো হয়। অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্রটি এক হাজার ২৪২ মাইল দূরে অবস্থিত শত্রুঘাঁটিতে হামলা চালাতে সক্ষম। স্পুটনিক আমাদের আরো জানাচ্ছে যে ভারত অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ও ছয় হাজার ২০০ মাইল দূরে অবস্থিত শত্রুর টার্গেটে আঘাত করতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম The wire। সংবাদের শিরোনাম! At Uri ground zero of India-Pakistan tension, Villagers are fleeing in panic। অর্থাৎ উরি সীমান্ত এলাকায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। গ্রামবাসী পালাচ্ছে। তৃতীয় আরেকটি খবর গত ২৩ ফেব্রুয়ারির। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। পাকিস্তান এই বক্তব্যকে ‘অলীক কল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। উপরোল্লিখিত প্রতিটি সংবাদের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের প্রশ্নটি জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরনো। এই দ্বন্দ্বের কারণে তিন-তিনবার দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দুই-দুইবার—১৯৪৭-৪৮ সালে একবার, আর ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে কারগিলকে কেন্দ্র করে আরো একবার যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, যা কিনা জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতা দখল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। ভারত পর পর দুইবার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ওই ঘটনা পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সিপরির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৩৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে আর ভারতের রয়েছে ১২৫টি। ২০১৭ সালে উভয় দেশ ১০টি করে ওয়ারহেড তাদের পারমাণবিক শক্তিবহরে সংযুক্ত করে (Knoema January 23, 2018)। ভারত এরই মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পাঁচটি আকাশ প্রতিরক্ষার মিসাইল এস-৪০০ কিনতে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই এ চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় তারা। তাহলে পরবর্তী ২৪ থেকে ৫৪ মাসের মধ্যে এসব অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহ শেষ হবে। ৩০ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে এই মিসাইল সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর আগে জানুয়ারিতে (২০১৮) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ভারত সাত কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এস-৪০০ মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম। তাদের মতে, বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী এস-৪০০ এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই পাল্টে দেবে। মিসাইলটি পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক মিসাইল নসরকেও নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই অস্ত্র চুক্তি নতুন নয়। তবে নিঃসন্দেহে এই চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে অন্যতম বড় চুক্তি। এর আগে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার দিয়ে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্য কিনেছিল ভারত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন বলা যেতে পারে, একটি ট্যাংকের যে দাম, ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রাণঘাতী অসুখবিসুখ ঠেকানোর জন্য ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ছয় রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র এক ডলার। একটি মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের (যা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছে। দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড়পড়তা খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি ডুবোজাহাজের দাম ধরা হয় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে এক বছরের জন্য একজনকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে মোটামুটি পাঁচ ডলারের মতো ব্যয় হয়। অর্থাৎ একটি ডুবোজাহাজ কেনা মানে ছয় কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। ভারত ও পাকিস্তানে দারিদ্র্য আছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারতে কৃষক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। অথচ এই দেশ দুটিতে সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ফলে উত্তেজনা থাকবেই। চির বৈরী এই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো ভালো খবর নয়। গত দু-তিন বছর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। ১৩ ডিসেম্বর (২০০১) ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ওই হামলায় পাঁচজন হামলাকারীসহ ১৩ জন নিহত হয়েছিল। ভারত ওই হামলার জন্য কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লস্কর-ই-তৈয়বা’ এবং ‘জইশ-ই-মোহাম্মদ’-কে দায়ী করেছিল। এবং এই দুটি জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর ফিরে আসেনি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির লাহোর সফর (১৯৯৯) ও সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আগ্রা সফরের (২০০১) পর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে দেশ দুটি আরো কাছাকাছি আসবে; কিন্তু তা হয়নি। বরং দেশ দুটির মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাকিস্তান মনে করে, ভারত বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের দিয়ে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করাচ্ছে! অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান মদদ দিচ্ছে—এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পাকিস্তান তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ককে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অবস্থান এখন ভারতের পক্ষে। সব মিলিয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছ
Daily Kalerkontho
08.03.2018
0 comments:
Post a Comment