ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত একটি
গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন অতিসম্প্রতি। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে
তিনি বলেছেন, ‘দেশটির (অর্থাৎ ভারতের) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে
বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদতে
একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ
করা হচ্ছে।’ একজন সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি
এই মন্তব্যটি করলেন এমন এক সময়, যখন আসামে একধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান
শুরু হয়েছে। এই বাঙালিরা মূলত মুসলমান। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এদের
বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। বিজেপি মনে করে, ওইসব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে
গেছেন এবং সেখানে বসবাস করছেন, যার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এর আগে
বিজেপি সরকার পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল।
এটা সম্ভব হয়নি মমতা ব্যানার্জির কারণে। বিপিন রাওয়াতের ওই বক্তব্য ভারতীয়
গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে। দ্য হিন্দু, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকায় বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যের সমালোচনা
করা হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যটি
‘রাজনৈতিক’। চলতি ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যাবেন। নিজের ‘রাজনৈতিক পথ’
পরিষ্কার করতেই তিনি ওই মন্তব্যটি করেছেন। বিপিন রাওয়াতের উদ্দেশ্য যা-ই
থাকুক না কেন, এটা সত্য দু-বছর আগেই আসাম সরকার নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি
কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এ সংক্রান্ত একটি
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অতিসম্প্রতি। আসাম সরকার ১ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের
একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের নাগরিকদের শনাক্ত
করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এতে কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমান সেখান থেকে বিতাড়িত
হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের যদি বাংলাদেশ গ্রহণ না করে, তা হলে তাদের
বন্দিশালায় রাখা হবে বলে একটি পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের
বন্দিশালা নির্মিত হয়েছে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন জেনারেল বিপিন রাওয়াত এ ধরনের একটি কথা বললেন। ফলে এ ধরনের বক্তব্য দুই
দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ সম্পর্ক একটি
উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে মোদির জমানায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার
ওপর গুরুত্ব দিয়েছে উভয় সরকার। এখন তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন, কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুইটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগতে সম্মত হয়েছেন। এই বিপিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহণে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এই চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, গণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছিল। ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (ইঈওগ) হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে এক সময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তীতে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমনার); রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত); রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর; রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানামার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলাই বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। মিয়ানমারের মান্দানায় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। পথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানিসম্পদ তথা কৃষি ও মৎস্যসম্পদ ব্যবহার করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটা বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখনও পুরোপুরিভাবে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপাক্ষিকতা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বাহুপাক্ষিতার আলোকেই রক্ষিত। ভারত এতে এখন সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এ মুহূর্তে দুটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এই সমস্যা দুটিই সমাধান সম্ভব। এই সমস্যা দুটি হচ্ছে পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে, যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে।
কিন্তু বিপিন রাওয়াতের মতো ব্যক্তিত্ব যখন বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন, তখন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে থাকে বৈকি। আমরা লক্ষ করেছি, মোদি সরকার জেনারেল রাওয়াতের ওই বক্তব্যের কোনো সমালোচনাও করেনি। রাওয়াত নিজে এর ব্যাখ্যাও দেননি। এখন দেখতে হবে, আসামে মুসলমানদের ভাগ্যে কী ঘটে? সত্যি সত্যিই তাদের একটা অংশকে যদি বন্দিশালায় রাখা হয়, তাহলে দু-দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা এ অঞ্চলের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
Daily Alokito Bangladesh
04.03.2018
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন, কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুইটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগতে সম্মত হয়েছেন। এই বিপিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহণে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এই চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, গণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছিল। ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (ইঈওগ) হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে এক সময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তীতে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমনার); রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত); রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর; রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানামার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলাই বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। মিয়ানমারের মান্দানায় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। পথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানিসম্পদ তথা কৃষি ও মৎস্যসম্পদ ব্যবহার করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটা বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখনও পুরোপুরিভাবে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপাক্ষিকতা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বাহুপাক্ষিতার আলোকেই রক্ষিত। ভারত এতে এখন সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এ মুহূর্তে দুটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এই সমস্যা দুটিই সমাধান সম্ভব। এই সমস্যা দুটি হচ্ছে পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে, যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে।
কিন্তু বিপিন রাওয়াতের মতো ব্যক্তিত্ব যখন বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন, তখন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে থাকে বৈকি। আমরা লক্ষ করেছি, মোদি সরকার জেনারেল রাওয়াতের ওই বক্তব্যের কোনো সমালোচনাও করেনি। রাওয়াত নিজে এর ব্যাখ্যাও দেননি। এখন দেখতে হবে, আসামে মুসলমানদের ভাগ্যে কী ঘটে? সত্যি সত্যিই তাদের একটা অংশকে যদি বন্দিশালায় রাখা হয়, তাহলে দু-দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা এ অঞ্চলের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
Daily Alokito Bangladesh
04.03.2018
0 comments:
Post a Comment