উত্তর-পূর্ব ভারতে গেরুয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। চার বছর আগে যে
গেরুয়া বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, তা এখন ভারতের উত্তর-পূর্ব
রাজ্যগুলোয় সম্প্রসারিত হলো। অর্থাৎ বিজেপি এখন এসব রাজ্যে দলীয়ভাবে এবং
শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করেছে। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে
এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা ট্র্যাডিশনালি এই এলাকা বাম ও স্থানীয়
দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এরাই নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। কংগ্রেসের
কিছুটা প্রভাব থাকলেও বিজেপির আদৌ কোনো প্রভাব ছিল না। কিন্তু এবার দেখা
গেল ভিন্ন চিত্র। বদলে গেল স্থানীয় রাজনীতির ইতিহাস। সবাইকে অবাক করে দিয়ে
বিজেপি উত্তর-পূর্ব ভারতে তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো।
এটাই ‘মোদি ম্যাজিক’। ২০১৪ সালে মোদি তার ক্যারিশমা দিয়ে ভারত জয়
করেছিলেন। তখন উত্তর-পূর্ব ভারতে তার কর্তৃত্ব ছিল না। এখন তা প্রতিষ্ঠিত
হলো। অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে এখন বিজেপি
তথা এনডিএ জোটের সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। এখন বাকি শুধু মিজোরাম। সেখানে
কংগ্রেস সরকার বহাল রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর সেখানে যে বিধানসভার
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে পু লালথানহাওলার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস
পার্টি (৪০ আসনের মধ্যে ৩২ আসনে বিজয়ী) বিজয়ী হয়ে লালথানহাওলার নেতৃত্বাধীন
সরকার সেখানে গঠিত হয়েছিল। চলতি বছরের শেষের দিকে সেখানে বিধানসভার
নির্বাচন। মণিপুরে (২০১৭) নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন
এন বিরেন সিং। আর ২০১৬ সালে অরুণাচলের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী
হয়ে প্রেম খানডুর নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি
(২০১৮) ত্রিপুরা, মেঘালয় আর নাগাল্যান্ডে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ফল প্রকাশ করা হয় ৩ মার্চ। আর এই তিন রাজ্যেই বিজেপি ও বিজেপি জোটের শরিকরা
সরকার গঠন করেছে। ত্রিপুরায় বামফ্রন্টকে পরাজিত করে বিজেপি এককভাবে বিজয়ী
হয়েছে (৬০ আসনের বিধানসভায় ৪১ আসন)। আর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন
বিপ্লব দেব। মেঘালয়ে কংগ্রেস এককভাবে বেশি আসনে বিজয়ী হলেও (২১) মাত্র দুটি
আসন নিয়ে বিজেপি তার মিত্র ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বে একটি
সরকার গঠন করেছে। এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর
নাগাল্যান্ডে বিজেপি-এডিপিপি জোট (৩০ আসন) সরকার গঠন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী
হয়েছেন নেফিয়ু রিও। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায়
থাকা বামফ্রন্টের পতন। এই প্রথমবারের মতো বামদের হটিয়ে বিজেপি সেখানে
সরকার গঠন করেছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামফ্রন্ট সেখানে ক্ষমতায় ছিল।
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সেখানে রাজ্য সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন ১৯৯৮
সাল থেকে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৮ সময়টা একেবারে কম নয়। তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট
ত্রিপুরায় পরপর চারবার বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চমবার
তিনি ব্যর্থ হলেন বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় নিতে। অত্যন্ত সাধাসিধে ও ‘গরিব’
মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর
মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। বলা
হয় অরুণাচল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (কংগ্রেস দলীয়) গেগং আপাং ছিলেন দীর্ঘ
সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী। দু-দফায় (১৯৮০-১৯৯৯, ২০০৩-২০০৭) তিনি ২৪ বছরর
ক্ষমতায় ছিলেন। একজন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে মানিক সরকারের পরিচিত
রয়েছে। বোধকরি তিনি একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যার কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। তিনি
নিজে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন না। ব্যাংকে তার জমানো কোনো ব্যালেন্সও নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেতন পেতেন মাসে ২৬ হাজার ৩১৫ রুপি। কিন্তু
পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো টাকাটা তিনি পার্টি ফান্ডে দান করতেন। তবে
পার্টি থেকে তিনি মাসে ৫ হাজার রুপি ভাতা পেতেন, যা দিয়ে তার সংসার চলত
(ডেকান হেরাল্ড)। এ ধরনের একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির
অভিযোগ নেই, তার নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট হেরে গেল কেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের।
তাহলে কি ত্রিপুরার মতো রাজ্যে, যেখানে বামফ্রন্ট অন্যতম শক্তি হিসেবে
সমাজে বিদ্যমান ছিল, নতুন প্রজন্ম কি সেই শক্তির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে
ফেলল? এ প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হবে এবং নিশ্চয়ই সিপিএম নেতারা এসব বিষয়
নিয়ে ভাববেন। সেই সঙ্গে আরও একটা কথাÑ একসময় বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের
বিকল্প ভাবা হতো। সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর কলকাতায় ক্ষমতায় থেকে একটি বিকল্প
রাজনীতি উপহার দিয়েছিল ভারতে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর কেরালায় বাম
রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি ছিল। জনগণের ভোটে তারা বারবার ক্ষমতাসীন হয়েছেন;
কিন্তু ২০১১ সাল থেকেই ছন্দপতন শুরু হয়েছে। প্রথমে গেল পশ্চিমবঙ্গ। এককভাবে
মমতা ব্যানার্জি সিপিএম তথা বামফ্রন্টবিরোধী অবস্থান নিয়ে সেখানে
বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। এখন ৭ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল
ত্রিপুরায়। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই ধারাবাহিকতায় কেরালায়ও কি বাম সরকারের পতন
ঘটবে? কেরালায় নির্বাচন হবে তিন বছর পর। সেখানে সিপিএম নানা
অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারায়েই ভিজয়ান অসুস্থ। গত ২৫
মে ২০১৬ সেখানে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বামফ্রন্ট ১৪০
আসনের বিধানসভায় ৯২টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন ভিজয়ান। যারা কেরালার
রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন কেরালার রাজনীতি মূলত
নিয়ন্ত্রণ করে সিপিএমের নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট আর ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস।
বারবার এদের মাঝে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনেও (২০১৫) বিজেপি
এখানে সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০১১ সালের
১৮ মে সেখানে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর
দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন অউমেন চান্ডি। আবার এর আগের নির্বাচনে (২০০৬) বিজয়ী
হয়েছিল বামফ্রন্ট। এর অর্থ পরিষ্কার, ক্ষমতার পালাবদল ঘটে বামফ্রন্ট আর
কংগ্রেসের মাঝে। বিজেপি এখানে আদৌ ফ্যাক্টর নয়। এই বিজেপি ত্রিপুরায় আদৌ
ফ্যাক্টর ছিল না। ১৯৮৩ সালের পরিসংখ্যান বলে, ত্রিপুরায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল
০.০৬ ভাগ, আর ২০১৩ সালের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট
ছিল মাত্র ১.৫৪ ভাগ। এই বিজেপিই এবার (২০১৮) ভোট পেল ৪১.২০ ভাগ। অর্থাৎ
এখানে ‘মোদি-ম্যাজিক’ কাজ করেছে। সুতরাং বিজেপির পরবর্তী টার্গেট যে
কেরালা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে পাঠকদের আরও কিছু তথ্য দিই।
প্রখ্যাত বাম নেতা নামবুদ্রিপাদ ছিলেন কেরালার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৭ ও
১৯৬৭ সালের বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে)। আবার কংগ্রেস নেতা করুণাকরণ ও এ
কে এটনিও ছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী। কোরালা বারবার ভারতের জাতীয় নেতৃত্ব
তৈরি করেছে। তাই প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক, কেরালায় সিপিএমের বিকল্প কি
বিজেপি হতে পারবে?
এটা বলতে দ্বিধা নেই, ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদি-ম্যাজিক’ ভারতজুড়ে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মানুষ মোদির কথায় সেদিন আশ্বাস রেখেছিল। বিজেপিকে তিনি বিজয়ী করে দিল্লির মসনদে বসিয়েছিলেন। এরপর এক কঠোর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। একসময় মানুষ বিজেপির নাম জানত না। এখন জানে। এটা মোদির সাফল্য, এটা বলতেই হবে। ইতোমধ্যে বিজেপি ভারতব্যাপী কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় যে বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাম রাজনীতি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। অতি কঠোর হিন্দুত্ববাদ এখন দখল করেছে সে জায়গা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ‘জয়যাত্রা’ থেমে গেছে। হিন্দুত্ববাদই এখন একুশ শতকের ভারতের মূল রাজনীতি! সত্তর দশকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী প্রচ- জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ছিলেন। এখন সে স্থান দখল করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে এখন বিজেপি ক্ষমতায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির এখন দরকার আটটি রাজ্যÑ পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিলনাড়–, মিজোরাম। দিল্লি ও পদুচেরি, যা কেন্দ্রশাসিত, সেখানেও ‘গেরুয়া শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি। এসব রাজ্যে কোথাও কংগ্রেস, আর কোথাও আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায়। কংগ্রেস নতুন নেতৃত্বে এসেছে। রাহুল গান্ধী এখন কংগ্রেসের সভাপতি। কিন্তু মোদির বিকল্প হিসেবে তিনি এখনও নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তার ব্যর্থতা সেখানেই। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনের ফলই এর বড় প্রমাণ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির ফলে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। ত্রিপুরায়ও কি আসামের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? আসামে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের যাদেরকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে! আসাম সরকার ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার একটা সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এখন ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের সরকার কি একই নীতি অবলম্বন করবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের প্রায় সবাই দেশ শত্রুমুক্ত হলে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কেউ কেউ থেকে গিয়েছিলেন বৈকি। এরা পশ্চিমবঙ্গে কোনো ঝুঁকির মুখে নেই। কেননা মমতা ব্যানার্জি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আসামে ও ত্রিপুরায় এখন বিজেপি সরকার।
তারা এসব ‘বাঙালি’কে ফেরত পাঠাতে চায়। তবে এখানে একটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিজেপি ভারতে থাকতে দিতে চায়, মুসলমানদের নয়। ফলে বিপ্লব দেবের মতো লোকও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন, যার বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুরের কচুয়া থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তার কোনো সমস্যা না হলেও মুসলমানদের সেখানে সমস্যা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরায় নির্বাচনের আগে বিজেপি সেখানকার আদিবাসীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এখন বিপ্লব দেবের সরকার কি তা বাস্তবায়ন করবে? এ ধরনের কোনো উদ্যোগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সেখানেও পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে পারে। তৃতীয়ত, ত্রিপুরায় বিজেপির বিজয়ের পর সেখানে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। এটা একটা ভিন্ন মেসেজ দিল। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ। আরএসএসের ছত্রছায়ায় যিনি বেড়ে উঠেছেন, তিনি কি এখন এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দেবেন? সুতরাং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন’ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর জবাব আমরা শুধু আগামীতেই দিতে পারব।
Daily Alokito Bangladesh
11.03.2018
এটা বলতে দ্বিধা নেই, ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদি-ম্যাজিক’ ভারতজুড়ে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মানুষ মোদির কথায় সেদিন আশ্বাস রেখেছিল। বিজেপিকে তিনি বিজয়ী করে দিল্লির মসনদে বসিয়েছিলেন। এরপর এক কঠোর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। একসময় মানুষ বিজেপির নাম জানত না। এখন জানে। এটা মোদির সাফল্য, এটা বলতেই হবে। ইতোমধ্যে বিজেপি ভারতব্যাপী কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় যে বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাম রাজনীতি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। অতি কঠোর হিন্দুত্ববাদ এখন দখল করেছে সে জায়গা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ‘জয়যাত্রা’ থেমে গেছে। হিন্দুত্ববাদই এখন একুশ শতকের ভারতের মূল রাজনীতি! সত্তর দশকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী প্রচ- জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ছিলেন। এখন সে স্থান দখল করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে এখন বিজেপি ক্ষমতায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির এখন দরকার আটটি রাজ্যÑ পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিলনাড়–, মিজোরাম। দিল্লি ও পদুচেরি, যা কেন্দ্রশাসিত, সেখানেও ‘গেরুয়া শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি। এসব রাজ্যে কোথাও কংগ্রেস, আর কোথাও আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায়। কংগ্রেস নতুন নেতৃত্বে এসেছে। রাহুল গান্ধী এখন কংগ্রেসের সভাপতি। কিন্তু মোদির বিকল্প হিসেবে তিনি এখনও নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তার ব্যর্থতা সেখানেই। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনের ফলই এর বড় প্রমাণ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির ফলে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। ত্রিপুরায়ও কি আসামের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? আসামে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের যাদেরকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে! আসাম সরকার ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার একটা সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এখন ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের সরকার কি একই নীতি অবলম্বন করবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের প্রায় সবাই দেশ শত্রুমুক্ত হলে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কেউ কেউ থেকে গিয়েছিলেন বৈকি। এরা পশ্চিমবঙ্গে কোনো ঝুঁকির মুখে নেই। কেননা মমতা ব্যানার্জি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আসামে ও ত্রিপুরায় এখন বিজেপি সরকার।
তারা এসব ‘বাঙালি’কে ফেরত পাঠাতে চায়। তবে এখানে একটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিজেপি ভারতে থাকতে দিতে চায়, মুসলমানদের নয়। ফলে বিপ্লব দেবের মতো লোকও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন, যার বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুরের কচুয়া থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তার কোনো সমস্যা না হলেও মুসলমানদের সেখানে সমস্যা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরায় নির্বাচনের আগে বিজেপি সেখানকার আদিবাসীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এখন বিপ্লব দেবের সরকার কি তা বাস্তবায়ন করবে? এ ধরনের কোনো উদ্যোগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সেখানেও পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে পারে। তৃতীয়ত, ত্রিপুরায় বিজেপির বিজয়ের পর সেখানে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। এটা একটা ভিন্ন মেসেজ দিল। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ। আরএসএসের ছত্রছায়ায় যিনি বেড়ে উঠেছেন, তিনি কি এখন এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দেবেন? সুতরাং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন’ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর জবাব আমরা শুধু আগামীতেই দিতে পারব।
Daily Alokito Bangladesh
11.03.2018
0 comments:
Post a Comment