এ নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. ইমরান খানকে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন তার কোয়ালিশন সরকারের পার্টনার? দুই. নির্বাচনে পিটিআই বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে সত্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছে সেনাবাহিনী। তারা যা চেয়েছিল তা-ই হয়েছে। একজন ‘দুর্বল’ প্রধানমন্ত্রী দরকার ছিল তাদের। তারা তা পেতে যাচ্ছে। তিন. ভারত ও আফগানিস্তান প্রশ্নে সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ একটি ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের’ দিকে যাচ্ছিলেন, যা সেনাবাহিনীর মনঃপূত হয়নি। ফলে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
এখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির এ বিষয়গুলো ‘দেখভাল’ করবে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া ভারতের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা যাবে না। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারটিও ঝুলে গেল। চার. এই নির্বাচন প্রমাণ করল মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এখনও একটি ‘শক্তি’। দলটির পাকিস্তানব্যাপী একটি জনপ্রিয়তা আছে। তারা (সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি দল) ভোটে কারচুপির অভিযোগ করেছে।
কিন্তু দলটি যদি এখন ‘মজলিশ-ই শূরা’য় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে, দলটি ভালো করবে। পাঁচ. নওয়াজ ও নওয়াজকন্যা মরিয়মের ‘মুক্তি’ আরও প্রলম্বিত হবে। খুব সহসা তারা জেল থেকে মুক্তি পাবেন বলে মনে হয় না। ছয়. মুসলিম লীগ (নওয়াজ) প্রধান শাহবাজ শরিফ জাতীয় রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি পাঞ্জাবের রাজনীতিতে ফিরে যাবেন, তা স্পষ্ট নয়। বড় ভাই নওয়াজ শরিফের মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা তিনি নন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা, তার কাছ থেকে তা প্রত্যাশা করা যায় না। ফলে তিনি হয়তো পাঞ্জাবে ফিরে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘দায়িত্ব’ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুসলিম লীগকে (নওয়াজ) মজলিশ-ই-শূরায় একজন ‘নেতা’ নির্বাচন করতে হবে, যিনি বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করবেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী একটি ফ্যাক্টর। একই সময় স্বাধীন হওয়া ভারত যখন একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, তখন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কখনই বিকশিত হয়নি। মাঝেমধ্যে নির্বাচিত সরকার একটি আস্থার জায়গা তৈরি করলেও অসাংবিধানিক শক্তিগুলো সবসময়ই পর্দার অন্তরালে থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এ অগণতান্ত্রিক শক্তিই ‘ডিপ স্টেট’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা এর একটি নতুন রূপ দেখলাম মাত্র। ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন সরকারি আমলা ও অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী। ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনকে পদচ্যুত করেন। তিনি গণপরিষদ ভেঙেও দিয়েছিলেন (১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট গঠিত)। বিষয়টি শেষ অব্দি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালে আদালত গোলাম মোহাম্মদের সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠনের পর ইসকান্দার মির্জা হন গভর্নর জেনারেল এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হন প্রধানমন্ত্রী। এই ইসকান্দার মির্জাই পাকিস্তানে সামরিক শাসন আনেন। কিন্তু আইয়ুব খানের হাতেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
এর পরের ইতিহাস তো সেনা শাসকদের ইতিহাস। আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে গণঅভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে (১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ)। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেয়ায় এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করায় পাকিস্তান ভেঙে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশে গণহত্যায় পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকেও সেনাবাহিনী ফাঁসিতে চড়িয়েছিল। যে জিয়াউল হককে ভুট্টো সেনাপ্রধান করেছিলেন, সেই জিয়াউল হকের ক্ষমতার লোভ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় রেখেছিল ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। এই জিয়াউল হকের সময়েই ব্যবসায়ী নওয়াজ শরিফের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর পাকিস্তানে কিছুদিনের জন্য হলেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু হয়েছিল (১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৩, ২০১৩ সালের নির্বাচন)। কিন্তু অসাংবিধানিক শক্তির কাছে গণতন্ত্র বারবার পরাজিত হয়েছে।
বেনজির ভুট্টো কিংবা নওয়াজ শরিফ তিন তিনবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তারা কেউই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। তবে ২০০৮ ও ২০১৩ সালের সরকার তাদের ৫ বছরের ম্যান্ডেট পূরণ করতে পেরেছিল। সেনাশাসক জেনারেল জিয়া নওয়াজ শরিফকে ‘তৈরি’ করলেও সেই সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থের কারণেই ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাবাহিনী কর্তৃক তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৮ সালে। এবার ক্ষমতাচ্যুত হন বিচার বিভাগ দ্বারা।
নির্বাচনের যে ফলাফল ঘোষিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় পিটিআই ১১৮, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ৫৯, পিপিপি ৪০, এমএমএ (ইসলামপন্থী অ্যালায়েন্স) ১১, বিএনপি-এম ৫, এমকিউএমপি ৫, জিডিএ ৩ সিট এবং স্বতন্ত্র ১৯ সিট পেয়েছে। পিটিআই, মুসলিম লীগ, পিপিপির শীর্ষ নেতারা একাধিক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। এ আসনগুলো তাদের ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে মুসলিম লীগ ও পিপিপিকে বাদ দিয়েও (যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন ইমরান এবং কোনো ধরনের জোট করবেন না বলে জানিয়েছেন) পিটিআইয়ের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব। সংবিধানের ৯১(২) ধারা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ১৫ আগস্টের আগেই সংসদ অধিবেশন ডাকতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে নতুন সরকার ১৫ আগস্টের আগেই শপথ নেবে, যাতে করে তারা স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারে। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন।
ইমরান খান জানিয়েছেন, তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে চান। কিন্তু এই ‘নয়া পাকিস্তান’ কেমন হবে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তবে দায়িত্ব নেয়ার আগে ‘জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে’ তিনি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, তিনি দরিদ্র ও এতিমদের জন্য দাতব্যমূলক ব্যবস্থা চালু করবেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। তিনি ‘মদিনা সনদ’ অনুযায়ী সরকার চালাবেন এমন কথাও বলেছেন।
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনা শরিফে এসেছিলেন। ভ্রাতৃত্ববোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৪৭ ধারা সংবলিত একটি সনদ প্রণয়ন করেছিলেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এটা ছিল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখন একুশ শতকে এসে ইমরান খান একধরনের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটা কতটুকু বাস্তবভিত্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি নিজে কতটুকু ইসলামী জীবনাচার মেনে চলেন, তা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের।
একাধিক নারীসঙ্গ, একাধিক বিয়ে, প্লে-বয়দের মতো জীবনযাপন, একজন ইহুদি নারীকে বিয়ে ও ডিভোর্স ইত্যাদি নানা বিতর্কিত ইস্যু রয়েছে তার জীবনে। তিনি একজন পিরানীকে (নারী পীর) বিয়ে করে পীর সম্প্রদায়ের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সবাই তাকে গ্রহণ করে নেবে, এটা মনে হয় না। সেনাবাহিনী তাকে ‘ইসলামী লেবাসে’ পরিচিত করাতে চাচ্ছে। নারী পীরকে ‘বিয়ে’ করানো সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থারই স্ট্র্যাটেজি।
যেহেতু সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্ম একটি ফ্যাক্টর, সেজন্যই সেনাবাহিনী চেয়েছে ইমরান খানকে ‘ইসলামী আদলে’ তৈরি করতে। সুতরাং ইমরান খানের মুখ থেকে যে ‘মদিনা সনদের’ কথা বের হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার ওই বক্তব্যে একটি ‘শান্ত আফগানিস্তান’, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কাশ্মীরই প্রধান আলোচ্য বিষয়, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা ইত্যাদি প্রসঙ্গও এসেছে। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এসব মূলত সেনাবাহিনীরই কথা। সেনাবাহিনীই চায় আফগানিস্তানে পাকিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারত আফগানিস্তানে বড় ভূমিকা পালন করছে, এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পছন্দ নয়। আর এ কারণেই আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
Daily Jugantor
28.07.2018
অনেক তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ স্যার
ReplyDelete