প্রথমত, দেশের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ এবার পর্যায়ক্রমে ভোট দেবেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা বিরল ঘটনা। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ পৃথিবীর কোনো দেশেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। দ্বিতীয়ত, এবার যোগ হয়েছে ১৩ কোটি নতুন ভোটার। এবারের ভোটারদের দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩৫ বা তার থেকে কম। তরুণ ভোটাররা ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কীভাবে দেখছে, একুশ শতকে তারা কেমন ভারত চায় কিংবা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তাদের সমর্থন কতটুকু আছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হবে। তৃতীয়ত, মোট ১৮৪১টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, যার মধ্যে সবগুলোই আঞ্চলিক দল। ভারতীয় রাজনীতি এক সময় নিয়ন্ত্রণ করত কংগ্রেস। দীর্ঘদিন কংগ্রেস এককভাবে শাসন করেছে। কিন্তু ১৯৮৯ সালের পর থেকেই কংগ্রেসের আর একক কর্তৃত্ব নেই। বিজেপি কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। চতুর্থত, সর্বভারতীয় রাজনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখন জোট রাজনীতি। বিজেপির নেতৃত্বে রয়েছে একটি জোট-এনডিএ, আর কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছে অপর একটি জোট-ইউপিএ। ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৩৬টি আসন (বিজেপি একাই পেয়েছিল ২৮২ আসন), আর ইউপিএ জোট পেয়েছিল ৬০ আসন (কংগ্রেসের আসন মাত্র ৪৪)। এবারেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দুই জোটের মাঝে।
পঞ্চমত, ভারতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় জোটের বিকাশ ঘটেনি। এক সময় সিপিআই (এম)-কে তৃতীয় শক্তি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু সিপিআই (এম) এখন বিলীন হওয়ার মুখে। কোনো কোনো রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো (সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি- উত্তর প্রদেশ) শক্তিশালী হলেও তৃতীয় শক্তি হিসেবে আঞ্চলিক দলগুলোর সর্বভারতব্যাপী উত্থান ঘটেনি। ফলে সুযোগ তৈরি হয়েছে ‘এনডিএ’ ও ‘ইউপিএ’ জোটের জন্য। মমতা ব্যানার্জি কলকাতায় সভা করে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ স্থায়ী হয়নি। তবে আঞ্চলিক দলগুলো এবার ফ্যাক্টর।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো যে কত শক্তিশালী, তা একটা পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২ আসনের মধ্যে লোকসভায় তৃণমূলের আসন ৩৪টি, উড়িষ্যাতে ২১ আসনের ২০টিতে আছে বিজেডি, তামিলনাড়ুর ৩৯ আসনের মধ্যে ৩৭ আসনে এডিএমকে, তেলেঙ্গানার ১৭ আসনের ১১ আসন স্থানীয় দল টিআরএসএর। লোকসভায় বেশি আসন রয়েছে উত্তর প্রদেশে (৮০), অন্ধ্র, (২৫), বিহার (৪০), গুজরাত (২৬), মহারাষ্ট্র (৪৮), মধ্যপ্রদেশ (২৯) ও রাজস্থান (২৫)। এইসব রাজ্যে কোথাও
কোথাও বিজেপি স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য করেছে। যেমন অন্ধ্রে তেলেগু দেশম (১৫) এর সঙ্গে, বিহারে এলজিপি ও আরএসএসপির সঙ্গে (বিজেপির আসন ২২), মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও এসডব্লিউপির সঙ্গে, পাঞ্জাবে (১৩) আকালি দলের সঙ্গে, উত্তর প্রদেশে আপনা দলের সঙ্গে।
স্থানীয় দলের সঙ্গে ঐক্য করে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) তাদের আসন বৃদ্ধি করেছিল। উত্তর প্রদেশের কিংবা বিহারের রাজনীতি বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করে নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এর ব্যত্যয় ঘটে। উত্তর প্রদেশে বিজেপি পেয়েছিল ৭১ আসন (৮০ আসনের মাঝে)। বিহারে পেয়েছিল ২২ আসন। দিল্লির ৭ আসনই পেয়েছিল (মোট আসন ৭) বিজেপি। অথচ দিল্লি নিয়ন্ত্রণ করে আম আদমি পার্টি। কর্নাটকে (২৮) ১৭ আসন, মধ্যপ্রদেশে ২৬ আসন (২৯), রাজস্থানে ২৫ (২৫) আসন, উত্তরাখন্ডে ৫ আসন (৫) পেয়ে বিজেপি চমক দেখিয়েছিল। কিন্তু এবার কি সেই চমক দেখাতে পারবে বিজেপি? উত্তর প্রদেশে বিজেপির ভোট কাটতে মায়াবতী (বহুজন সমাজবাদী পার্টি), অখিলেশ যাদব (সমাজবাদী পার্টি), অজিত সিং (রাষ্ট্রীয় লোকদল) জোটবদ্ধ হয়েছেন। এতে করে ভোটের প্যাটার্ন বদলে যেতে পারে। উত্তর প্রদেশে এই জোট বেশি আসন পেতে পারে। সেই সঙ্গে পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল, কেরলে বামফ্রন্ট, উড়িষ্যায় বিজেডি, তামিলনাড়ুতে এডিএমকে এবং তেলেঙ্গানায় টিআরএস, বড় আসনের ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারে।
মজার ব্যাপার মোট ৩৬টি রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য আসন রয়েছে পশ্চিম বাংলার মাত্র ৪, অসম ৩, কর্নাটক ৯, কেরালা ৮ এবং পাঞ্জাবে ৩। এই সীমিত সংখ্যক আসন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করা অকল্পনীয় ব্যাপার। আঞ্চলিক বড় দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য করতেও পারেনি কংগ্রেস। মায়াবতী ও মমতা ব্যানার্জি বরাবরই কংগ্রেসের সমালোচনা করে আসছেন। মোদিকে ‘ঠেকাতে’ কৌশলগত কারণে কংগ্রেস যদি মায়াবতী কিংবা মমতা ব্যানার্জিকে সমর্থন করে, তাহলে কেন্দ্রে একটি বিজেপিবিরোধী সরকার গঠন করা সম্ভব। কিন্তু এই সম্ভাবনা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। রাস্তায় এর কোনো ভিত্তি নেই। নির্বাচনী প্রচারণায় রাহুল গান্ধী, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব কিংবা মমতা ব্যানার্জির বক্তব্যে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনার
কথাও শোনা যায়নি। আর এতেই সুযোগ তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র মোদির জন্য। বিরোধী দলগুলোর এক প্ল্যাটফর্মে না আসার ব্যর্থতায় নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার।
২০১৪ সালে ‘মোদি ম্যাজিক’ ভারতব্যাপী একটি ক্রেজ তৈরি করেছিল। মোদির বক্তব্য, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝটিকা সফর, মাঠে মাঠে বক্তৃতা দেওয়া কিংবা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি তাকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। মোদি নিজেকে জওয়াহেরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারী বাজপেয়ির মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের পাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটা তার সাফল্য। নেহরু পরিবারের বাইরে তিনি নিজেকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির যে উত্থান, তাতে মোদির অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাঘা বাঘা বিজেপি নেতাদের কৌশলে হটিয়ে তিনি দলে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। এমনকি তার কূটকৌশলের কারণে আদভানির মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাও রাজনীতি থেকে অনেকটা ‘বিদায়’ নিয়েছেন। আদভানি এবারে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। চিন্তা করা যায় লোকসভা নির্বাচনে ১৯৮৪ সালে বিজেপি যেখানে পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন, ১৯৮৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৮টিতে, ১৯৯১ সালে ১১৯টিতে, আর ২০১৪ সালে এই আসন সংখ্যা ২৮২ (এনডিএ জোটের ৩৩৬)। এবার হয়তো আসন কিছুটা কমবে, কিন্তু এনডিএ জোটই সরকার গঠন করবে। জনমত জরিপ তাই বলছে।
এক সময় কংগ্রেস ছিল সর্বভারতব্যাপী একক একটি শক্তি। দীর্ঘ ৪৪ বছর কংগ্রেস ভারত শাসন করেছে। মূলত রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর পরই কংগ্রেসে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি জন্মগতভাবে ভারতীয় ছিলেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য পথ অতটা মসৃণ ছিল না। দীর্ঘদিন পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব দিলেও তিনি আর একজন রাজীব গান্ধী হতে পারেননি। উপরন্তু ততদিনে ভারতীয় রাজনীতিও অনেক বদলে গেছে। কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বিজেপি। বিজেপি তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সামনে রেখে সাধারণ ভারতীয়দের মাঝে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছিল। কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে জনতা পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। দলের পক্ষ থেকে মোরারজি দেশাই (১৯৭৭-৯১), চরণসিং (১৯৭৯-৮০), ভিপি সিং (১৯৮৯-৯০), চন্দ্রশেখর (১৯৯০-৯১), দেবগৌড়া (১৯৯৬-৯৭) কিংবা আইকে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব ইত্যাদি নানা কারণে জনতা পার্টির সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছিল। আর এই সুযোগেই অতি হিন্দুত্ববাদ প্রচার করে বিজেপি সর্বভারতব্যাপী তার অবস্থান শক্তিশালী করেছিল। ভারতের অনেক রাজ্যেই এখন বিজেপি ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার অংশীদার।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ‘মোদি ম্যাজিক’ কাজ করেছিল। কিন্তু এবার ‘মোদি ম্যাজিক’ কাজ করছে না। অনেক প্রতিশ্রুতিই তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতি বছর তিনি এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। তিনি তা পারেননি। ফলে তারা তার ওপর বিরক্ত। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগেরই কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ নেই। বিবিসির ভাষ্য মতে বেকার সমস্যার হার বর্তমানে ৬ দশমিক ১ ভাগ, এটা ২০১৪ সালে ছিল অনেক কম। ২০১৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ১ ভাগ, ২০১৭ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭ ভাগ। তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও ব্যাপক। যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। তিনি গত ৫ বছরে ব্যাপকভাবে বিদেশ সফর করেছেন। কিন্তু সেভাবে তিনি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারেননি। তিনি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছেন এনআরবি নিয়ে। এনআরবি’র আওতায় তিনি ‘অবৈধ’ মুসলমানদের বের করে দিতে চান, হিন্দুদের ভারতে বসবাস করার সুযোগ দিতে চান। প্রয়োজনে তিনি এ জন্য ভারতীয় সংবিধান সংশোধনও করতে চান। তার এই সিদ্ধান্ত সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন। তিনি ‘নমো টিভি’ চালু করে নিজের ‘বায়োপিক’ তৈরি করে এক ধরনের ‘কাল্ট রাজনীতি’ চালু করতে চেয়েছিলেন। যদিও শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপে তার ‘বায়োপিক’ আটকে যায়। বিজেপি তার ইশতেহারে রামমন্দির ও নতুন ভারত গড়ার সংকল্পের কথা বলেছে। রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা, অভীষ্ট দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন, সংবিধানের ধারা পরিবর্তন করে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সংবিধানিক অধিকার বাতিল করা, ইত্যাদি যে ‘প্রতিশ্রুতি’ তিনি দিয়েছেন, তা ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরও উৎসাহ জোগাবে মাত্র। বিজেপির পাশাপাশি কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি।
ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ হচ্ছে এই লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারত আগামী ৫ বছরের জন্য একটি নয়া সরকার পাবে বটে, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ভারতের গণতান্ত্রিক ‘চরিত্র’ এর মধ্য দিয়ে কতটুকু বদলে যাবে, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Desh Rupantor
14.04.2019
0 comments:
Post a Comment