গত মার্চ গত মার্চমাসের মাঝামাঝি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের
সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই গত রবিবার শ্রীলঙ্কায়
সন্ত্রাসবাদী হামলায় মারা গেলেন ২৯০ জন, যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশিও
রয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসবাদী হামলায় জড়িত ছিল একজন—ব্রেন্টন
টারান্ট, যে উগ্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষী মানসিকতায়
বিশ্বাসী ছিল। ওই হামলায় মসজিদে নামাজ আদায়রত ৪৯ জন মুসলমান সাধারণ মানুষকে
ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল ব্রেন্টন টারান্ট। এখন অবধি এটা নিশ্চিত হওয়া
যায়নি ক্রাইস্টচার্চের হামলার সঙ্গে আদৌ কোনো সংগঠন জড়িত ছিল কি না? কিন্তু
কলম্বোসহ তিন স্থানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশি।
এটা একক কোনো সন্ত্রাসীর কাজ নয়। একাধিক স্থানে প্রায় একই সময় সন্ত্রাসী
হামলা প্রমাণ করে এটা অনেকটা পরিকল্পিত। এবং আইএসের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো
শ্রীলঙ্কান সংগঠন এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে, যদিও কোনো সংগঠনই এর দায়ভার
এখন অবধি স্বীকার করেনি।
পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর আইএস বা ইসলামিক স্টেট হুমকি দিয়েছিল ৪৯ জন মুসলমান নাগরিককে হত্যার তারা প্রতিশোধ নেবে। এখন কলম্বোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেল। সিরিয়া থেকে আইএসের উৎখাতের পর ধারণা করা হয়েছিল আইএস তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। কিন্তু কলম্বোর ঘটনাবলিতে প্রমাণিত হলো সন্ত্রাসীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করেছে। সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাতের পর আইএস যোদ্ধাদের একটা অংশ ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আরেকটি অংশ চলে গেছে আফ্রিকায়, বিশেষ করে মালিতে। এখন দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার মতো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশকেও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বেছে নিয়েছে। এর পেছনে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। শ্রীলঙ্কায় গত প্রায় ১০ বছর তেমন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। একসময় তামিল টাইগাররা এসব আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাত। তামিল টাইগাররা একসময় পৃথিবীর অন্যতম জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। যদিও তারা ধর্মকে কখনোই ব্যবহার করেনি। বরং স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ ২৬ বছর তারা ‘যুদ্ধ’ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হাতে টাইগারদের শীর্ষ নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর পর টাইগারদের আন্দোলনেও ভাটা পড়ে। গত ১০ বছর তামিল টাইগারদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধদের সংঘর্ষের খবর সাম্প্রতিককালে একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে বৌদ্ধদের মধ্যে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনের (বদু বালা সেনা) নাম পাওয়া যায়, যারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এরা কলম্বোতে বাংলাদেশ দূতাবাসেও একবার হামলা চালিয়েছিল। আইএস তাদের সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে এই শ্রীলঙ্কাকেই তাই বেছে নিয়েছে তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে।
আইএসের খেলাফতের পতন হয়েছে। সিরিয়ার রাকা ছিল তাদের অলিখিত রাজধানী। এত দিন তারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন ও ব্রাসেলসের মতো শহরে ‘লোন উলফ’ বা ‘একক সন্ত্রাসী হামলার’ মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছিল। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও তারা ‘লোন উলফ’-এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে কম। যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে আইএস তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এ আলোকেই রচিত। তবে শ্রীলঙ্কায় এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। এএফপি আমাদের জানাচ্ছে, ২০ এপ্রিলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্তত ১০ দিন আগে শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুযুথ জয়াসুন্দরা শ্রীলঙ্কায় সম্ভাব্য একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন। ১১ এপ্রিল ওই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল বলে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা প্রিয়লাল দেশনায়েকে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন (ডেইলি মিরর, ২২ এপ্রিল)।
সংবাদপত্রে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার তথ্য সরবরাহ করেছিল। অন্তত ৩০ মিনিট আগেই শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দারা জানত, একটি সন্ত্রাসী হামলা হতে যাচ্ছে! সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিল না কেন? এটা কি শুধুই শৈথিল্য? সন্ত্রাসী হামলাকে সিরিয়াসলি না নেওয়া? নাকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে জঙ্গিদের ‘পেনেট্রেশন’ ঘটেছে? বিবিসিকে একজন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী এটা স্বীকার করেছেন যে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত ছিলেন না। তবে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যখন আইএস ক্রাইস্টচার্চের গণহত্যার বদলা নেওয়ার কথা বলছিল, তখন শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কাউন্টার টেররিজম ফোর্স গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শ্রীলঙ্কা কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কায় ‘ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত’ বা এনটিজে নামে একটি উগ্র ইসলামিক সংগঠনের খবর পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এনটিজের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। এনটিজেকে বলা হয় আইএসের পূর্বসূরি। এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড আছে। গেল বছর এরা বেশ কিছু স্ট্যাচু ভেঙে আলোচনায় এসেছিল। এই হামলার সঙ্গে এনটিজের কতটুকু যোগসূত্র আছে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব এখন শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘স্থানীয় সংগঠন’ জড়িত। যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম বলা হয়নি। শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা গুনাসেকারা এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, স্থানীয় সংগঠনই এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। জাহরান হাশিম নামে একজন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিদেশ থেকে তার ছবি ‘আপলোড’ করা হয়েছে। সুতরাং এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাহরান হাশিমের সংশ্লিষ্টতা কী, তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল কিংবা তিনি কাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এসব এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মুসলমানদের বলা হয় শ্রীলঙ্কার ‘ভূমিপুত্র’ অর্থাৎ আদি বাসিন্দা। অতীতে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থানের পরপরই সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্বে ‘ইসলামিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম, যারা মুসলমান, তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করেছে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে এর প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই ‘ইসলামিক আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রীলঙ্কায় এনটিজের উত্থান এভাবেই। এখন তদন্তেই বেরিয়ে আসবে এরা কতটুকু জড়িত ছিল। তবে ওদের সঙ্গে আইএসের কোনো যোগসূত্র নেই, কিংবা আইএস এদের উৎসাহিত করেনি এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে, তা বলা যাবে না। আগামী দিনে যদি আইএসের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার কথা ঘোষণা করা হয়, আমি অবাক হব না।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল, ঠিক তখনই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শ্রীলঙ্কার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে—৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ বিলিয়নে। শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালে যে সংখ্যা ৫০ হাজারে, ২০১৮ সালে তা বেড়েছে দুই লাখ ৫০ হাজারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কায়ই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। এ ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে করে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুটি ইসলামিক সংগঠন (শ্রীলঙ্কার)—‘দি মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘আয় সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’—এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান ধর্মীয় নেতা ‘শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে। তারা এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করতে পারে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুধু শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওয়েক আপ’ কলই নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। অতীতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তবে আমাদের ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে—এটা বলা যাবে না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মূল হয়েছে। ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে, এমন অভিযোগ শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। তরুণ প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলিকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি না ছড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের মাত্রা কমেছে, এটা বলা যাবে না। গবেষকদের তথ্য মতে, গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আল শাবাব (সোমালিয়া), তালেবান (আফগানিস্তান), ইসলামিক স্টেট (আফগানিস্তান), দোজো মিলিশিয়া (মালি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (কাশ্মীর), তাহরিক-ই-তালেবান (পাকিস্তান), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল-কায়েদা (ইয়েমেন), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (বেলুচিস্তান) জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আইএস ও তালেবান। এরা সবাই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রীলঙ্কার নাম। অতীতে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা। এখন সেটা অতীত। এখন যুক্ত হলো ‘ইসলামিক’ সন্ত্রাসবাদীরা। এটা শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়
Daily Kalerkontho
23.04.2019
পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর আইএস বা ইসলামিক স্টেট হুমকি দিয়েছিল ৪৯ জন মুসলমান নাগরিককে হত্যার তারা প্রতিশোধ নেবে। এখন কলম্বোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেল। সিরিয়া থেকে আইএসের উৎখাতের পর ধারণা করা হয়েছিল আইএস তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। কিন্তু কলম্বোর ঘটনাবলিতে প্রমাণিত হলো সন্ত্রাসীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করেছে। সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাতের পর আইএস যোদ্ধাদের একটা অংশ ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আরেকটি অংশ চলে গেছে আফ্রিকায়, বিশেষ করে মালিতে। এখন দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার মতো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশকেও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বেছে নিয়েছে। এর পেছনে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। শ্রীলঙ্কায় গত প্রায় ১০ বছর তেমন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। একসময় তামিল টাইগাররা এসব আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাত। তামিল টাইগাররা একসময় পৃথিবীর অন্যতম জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। যদিও তারা ধর্মকে কখনোই ব্যবহার করেনি। বরং স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ ২৬ বছর তারা ‘যুদ্ধ’ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হাতে টাইগারদের শীর্ষ নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর পর টাইগারদের আন্দোলনেও ভাটা পড়ে। গত ১০ বছর তামিল টাইগারদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধদের সংঘর্ষের খবর সাম্প্রতিককালে একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে বৌদ্ধদের মধ্যে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনের (বদু বালা সেনা) নাম পাওয়া যায়, যারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এরা কলম্বোতে বাংলাদেশ দূতাবাসেও একবার হামলা চালিয়েছিল। আইএস তাদের সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে এই শ্রীলঙ্কাকেই তাই বেছে নিয়েছে তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে।
আইএসের খেলাফতের পতন হয়েছে। সিরিয়ার রাকা ছিল তাদের অলিখিত রাজধানী। এত দিন তারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন ও ব্রাসেলসের মতো শহরে ‘লোন উলফ’ বা ‘একক সন্ত্রাসী হামলার’ মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছিল। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও তারা ‘লোন উলফ’-এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে কম। যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে আইএস তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এ আলোকেই রচিত। তবে শ্রীলঙ্কায় এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। এএফপি আমাদের জানাচ্ছে, ২০ এপ্রিলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্তত ১০ দিন আগে শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুযুথ জয়াসুন্দরা শ্রীলঙ্কায় সম্ভাব্য একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন। ১১ এপ্রিল ওই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল বলে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা প্রিয়লাল দেশনায়েকে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন (ডেইলি মিরর, ২২ এপ্রিল)।
সংবাদপত্রে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার তথ্য সরবরাহ করেছিল। অন্তত ৩০ মিনিট আগেই শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দারা জানত, একটি সন্ত্রাসী হামলা হতে যাচ্ছে! সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিল না কেন? এটা কি শুধুই শৈথিল্য? সন্ত্রাসী হামলাকে সিরিয়াসলি না নেওয়া? নাকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে জঙ্গিদের ‘পেনেট্রেশন’ ঘটেছে? বিবিসিকে একজন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী এটা স্বীকার করেছেন যে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত ছিলেন না। তবে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যখন আইএস ক্রাইস্টচার্চের গণহত্যার বদলা নেওয়ার কথা বলছিল, তখন শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কাউন্টার টেররিজম ফোর্স গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শ্রীলঙ্কা কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কায় ‘ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত’ বা এনটিজে নামে একটি উগ্র ইসলামিক সংগঠনের খবর পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এনটিজের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। এনটিজেকে বলা হয় আইএসের পূর্বসূরি। এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড আছে। গেল বছর এরা বেশ কিছু স্ট্যাচু ভেঙে আলোচনায় এসেছিল। এই হামলার সঙ্গে এনটিজের কতটুকু যোগসূত্র আছে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব এখন শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘স্থানীয় সংগঠন’ জড়িত। যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম বলা হয়নি। শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা গুনাসেকারা এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, স্থানীয় সংগঠনই এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। জাহরান হাশিম নামে একজন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিদেশ থেকে তার ছবি ‘আপলোড’ করা হয়েছে। সুতরাং এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাহরান হাশিমের সংশ্লিষ্টতা কী, তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল কিংবা তিনি কাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এসব এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মুসলমানদের বলা হয় শ্রীলঙ্কার ‘ভূমিপুত্র’ অর্থাৎ আদি বাসিন্দা। অতীতে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থানের পরপরই সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্বে ‘ইসলামিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম, যারা মুসলমান, তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করেছে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে এর প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই ‘ইসলামিক আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রীলঙ্কায় এনটিজের উত্থান এভাবেই। এখন তদন্তেই বেরিয়ে আসবে এরা কতটুকু জড়িত ছিল। তবে ওদের সঙ্গে আইএসের কোনো যোগসূত্র নেই, কিংবা আইএস এদের উৎসাহিত করেনি এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে, তা বলা যাবে না। আগামী দিনে যদি আইএসের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার কথা ঘোষণা করা হয়, আমি অবাক হব না।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল, ঠিক তখনই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শ্রীলঙ্কার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে—৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ বিলিয়নে। শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালে যে সংখ্যা ৫০ হাজারে, ২০১৮ সালে তা বেড়েছে দুই লাখ ৫০ হাজারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কায়ই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। এ ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে করে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুটি ইসলামিক সংগঠন (শ্রীলঙ্কার)—‘দি মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘আয় সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’—এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান ধর্মীয় নেতা ‘শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে। তারা এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করতে পারে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুধু শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওয়েক আপ’ কলই নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। অতীতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তবে আমাদের ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে—এটা বলা যাবে না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মূল হয়েছে। ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে, এমন অভিযোগ শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। তরুণ প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলিকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি না ছড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের মাত্রা কমেছে, এটা বলা যাবে না। গবেষকদের তথ্য মতে, গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আল শাবাব (সোমালিয়া), তালেবান (আফগানিস্তান), ইসলামিক স্টেট (আফগানিস্তান), দোজো মিলিশিয়া (মালি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (কাশ্মীর), তাহরিক-ই-তালেবান (পাকিস্তান), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল-কায়েদা (ইয়েমেন), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (বেলুচিস্তান) জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আইএস ও তালেবান। এরা সবাই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রীলঙ্কার নাম। অতীতে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা। এখন সেটা অতীত। এখন যুক্ত হলো ‘ইসলামিক’ সন্ত্রাসবাদীরা। এটা শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়
Daily Kalerkontho
23.04.2019
0 comments:
Post a Comment