দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো- এক. বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী ও উত্তর প্রদেশের চার চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যদিও মায়াবতী লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না; দুই. তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে হলে তৃণমূলের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, কেজরিওয়াল, চন্দ্রবাবু নাইডুর মতো নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে আসতে না পারলেও স্থানীয় তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের দলের প্রভাব অনেক বেশি। কোনো কোনো দলের আবার জাতীয় দলের স্বীকৃতিও নেই। ফলে সুযোগটি নিচ্ছে বিজেপি ও কংগ্রেসের মতো দল।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো যে কত শক্তিশালী, তা একটা পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় তৃণমূলের আসন ৩৪ (মোট আসন ৪২), উড়িষ্যাতে ২১ আসনের ২০টিতে আছে বিজেডি, তামিলনাড়ূর ৩৯ আসনের মধ্যে ৩৭ আসন এডিএমকের, তেলেঙ্গানার ১৭ আসনের ১১ আসন স্থানীয় দল টিআরএসের।
এসব রাজ্যে কোথাও কোথাও বিজেপি স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য করে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এবার কি সেই চমক দেখাতে পারবে বিজেপি? উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোট কাটতে মায়াবতী (বহুজন সমাজবাদী পার্টি), অখিলেশ যাদব (সমাজবাদী পার্টি), অজিত সিং (রাষ্ট্রীয় লোকদল) জোটবদ্ধ হয়েছে। এতে করে ভোটের প্যাটার্ন বদলে যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশে এই জোট বেশি আসন পেতে পারে। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল, কেরলে বামফ্রন্ট, উড়িষ্যায় বিজেডি, তামিলনাড়ূতে এডিএমকে এবং তেলেঙ্গানায় টিআরএস বড় আসনের ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারে।
মজার ব্যাপার, মোট ৩৬টি রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য আসন রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ৪, আসামে ৩, কর্ণাটকে ৯, কেরলে ৮ এবং পাঞ্জাবে ৩। এই সীমিত সংখ্যক আসন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করা অকল্পনীয় ব্যাপার। আঞ্চলিক বড় দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য করতে পারেনি কংগ্রেস। মায়াবতী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই কংগ্রেসের সমালোচনা করে আসছেন।
মোদিকে 'ঠেকাতে' কৌশলগত কারণে কংগ্রেস যদি মায়াবতী কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করে, তাহলে কেন্দ্রে একটি বিজেপিবিরোধী সরকার গঠন সম্ভব। কিন্তু এই সম্ভাবনা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। নির্বাচনী প্রচারে রাহুল গান্ধী, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনার কথা শোনা যায়নি। আর এতেই সুযোগ তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র মোদির জন্য। বিরোধী দলগুলোর এক প্ল্যাটফর্মে না আসার ব্যর্থতায় নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার।
২০১৪ সালে 'মোদি ম্যাজিক' সর্বভারতব্যাপী একটি ক্রেজ তৈরি করেছিল। মোদির বক্তব্য, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝটিকা সফর, মাঠে মাঠে বক্তৃতা দেওয়া কিংবা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি তাকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। মোদি নিজেকে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারি বাজপেয়ির মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের পাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটা তার সাফল্য। নেহরু পরিবারের বাইরে তিনি নিজেকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছেন। বাঘা বাঘা বিজেপি নেতাকে কৌশলে হটিয়ে তিনি দলে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। এমনকি তার কূটকৌশলের কারণে আদভানির মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাও আজ রাজনীতি থেকে অনেকটা 'বিদায়' নিয়েছেন। আদভানি এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। চিন্তা করা যায়- লোকসভা নির্বাচনে ১৯৮৪ সালে বিজেপি যেখানে পেয়েছিল মাত্র দুটি আসন, ২০১৪ সালে এই আসন সংখ্যা ২৮২ (এনডিএ জোটের ৩৩৬)! এবার হয়তো আসন কিছুটা কমবে; কিন্তু এনডিএ জোটই সরকার গঠন করবে। জনমত জরিপ তাই বলছে।
একসময় কংগ্রেস ছিল সর্বভারতব্যাপী একক একটি শক্তি। দীর্ঘ ৪৪ বছর কংগ্রেস ভারত শাসন করেছে। সেই কংগ্রেস ২০১৪ সালে পেয়েছিল মাত্র ৪৪ আসন (মোট আসন ৫৪৩)। মূলত রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরপরই কংগ্রেসে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি জন্মগতভাবে ভারতীয় ছিলেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার পথ অতটা মসৃণ ছিল না। দীর্ঘদিন পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিলেও তিনি 'আরেকজন রাজীব গান্ধী' হতে পারেননি। উপরন্তু ততদিনে ভারতীয় রাজনীতিও অনেক বদলে গেছে। কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বিজেপি। বিজেপি তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ সামনে রেখে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছিল। ভারতের অনেক রাজ্যেই এখন বিজেপি ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার অংশীদার।
পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজ্যে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন শেষে ২৩ মে ভোট গণনা শুরু হবে এবং ধারণা করছি, জুন মাসেই ভারত একটি নয়া সরকার পাবে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যে ইমেজ নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তার সেই ইমেজ এখন আর আগের মতো নেই। কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা তিনি পূরণ করতে পারেননি। বেকার সমস্যা সেখানে প্রবল। কর্মজীবী মানুষের মাঝে ৫০ শতাংশেরই কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ নেই। মোদি নিজেকে জনগণের সেবক বা চৌকিদার হিসেবে পরিচয় দেন; কিন্তু রাফায়েল নির্মাণ ক্রয় দুর্নীতিতে তিনি জড়িয়ে গেছেন। সামান্য চা বিক্রেতা থেকে তার রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল। কিন্তু সেই চা বিক্রেতার গায়েই উঠেছিল ১০ লাখ রুপির সুট, যখন তিনি ওবামাকে নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ডের জন্যও তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। রামমন্দির ইস্যুকে পুনরায় সামনে এনে তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দিয়েছেন। কৃষকদের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েও তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর 'ন্যায় প্রকল্প'ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তিনি অতি গরিব পরিবারকে মাসে ছয় হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা নিয়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে। সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চলছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারত একটি নয়া সরকার পাবে বটে; কিন্তু রাজনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে হয় না।
Daily Samakal
11.04.2019
0 comments:
Post a Comment