রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বনানীর ‘হত্যাকাণ্ড’ ও একটি খোলা চিঠি

Image result for Fire in Banani Dhaka

রাজধানীর বনানীর বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং গাফিলতির মাধ্যমে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড—এই অভিমত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের। তিনি আরো জানিয়েছেন, যারা এ ঘটনার জন্য দায়ী তারা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রীর এই বক্তব্যে একদিকে আমরা যেমন আশাবাদী, অন্যদিকে কিছুটা হতাশাগ্রস্তও বটে। আশাবাদী এই কারণে যে মন্ত্রী একজন আইনজীবী। তিনি জানেন, ২৬ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের শাস্তি কী হতে পারে! বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট বিধান আছে হত্যাকাণ্ডের শাস্তি কী। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, আদৌ কি এই ‘হত্যাকাণ্ডের’ বিচার হবে? অতীতে কি হয়েছে? আমরা কি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি নিমতলী, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল, তাদের সবাইকে আমরা বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করতে পেরেছিলাম? আমরা কি নিশ্চিত দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পেরেছি? মাননীয় মন্ত্রী আমি আশাবাদী নই। আমরা কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারিনি। বনানীর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলাটি করেছে, সেটিও হত্যা মামলা নয়, যদিও দুজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ বনানীর ‘হত্যাকাণ্ডে’ অনেক মন্ত্রীকে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে দেখেছি। উত্তরের সিটি করপোরেশনের মেয়র, এমনকি ডিএমপির কমিশনারও বলেছেন, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। এ ধরনের কথাবার্তা কি আমরা অতীতে শুনিনি? নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পরও কি আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলেননি!
অনেক সংবাদ বনানীর অগ্নিকাণ্ড ঘিরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। একজন বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতার নাম সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, যিনি অবৈধভাবে নির্মাণ করা ওই ভবনের ২১, ২২ ও ২৩ তলার মালিক। একটি বড় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের নামও সংবাদপত্রে এসেছে, যারা অবৈধভাবে অতিরিক্ত তলাগুলো নির্মাণ করেছিল। পুলিশের মহাপরিদর্শকের একটি যুক্তিযুক্ত বক্তব্যও এসেছে। আইজি সাহেব প্রশ্ন রেখেছেন, অবৈধভাবে ডেভেলপার ও মালিক পাঁচতলা বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৪ বছর রাজউক কী করেছে? তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নের পেছনে যুক্তি আছে। যদিও এখন শোনা যাচ্ছে, বর্ধিত পাঁচতলারও অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। পূর্তমন্ত্রী ওই সময় রাজউকের চেয়ারম্যান কে ছিলেন তাঁকে খুঁজছেন। এই খোঁজাটা ভালো। ওই সময় যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি একাই দায়ী? বর্তমান পূর্তমন্ত্রী কয়েক দিন আগেও রাজউকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে দেখেছেন, সেখানে অনেক ফাইল গায়েব হয়ে গেছে। রাজউকে শক্তিশালী একটি ‘চক্র’ কাজ করে। এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। এদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের অনেকেই অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে।
পূর্তমন্ত্রী নতুন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন। তিনি যে মন্তব্যটি করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা চাই না তিনি ব্যর্থ হন। তাঁর জন্য সুযোগ রয়েছে অনেক। তাঁকে তাঁর ‘যোগ্যতা’র প্রমাণ দেখাতে হবে। রাজউকে অনেক ভালো লোক আছেন। বর্তমান চেয়ারম্যানও যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। মন্ত্রী বাহাদুর, প্রয়োজনে আপনি নিত্য রাজউকে অফিস করে অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করুন। মানুষ আপনাকে সমর্থন করবে।
দুই.
বনানীর অগ্নিকাণ্ড পূর্তমন্ত্রীর জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। রাজউক উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে ৭৯টি বহুতল ভবন (১৬ তলা) নির্মাণ করেছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০৩০৭১.৮৭ লাখ টাকা। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এখানে অনেক পরিবার বসবাস শুরু করেছে। কিন্তু ভবনগুলোতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা যথাযথ নয়। অগ্নি-অ্যালার্ম সিস্টেম রাখা হয়নি। ওয়াসা পানি সরবরাহ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে আগুন লাগলে (?) ওয়াসা পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে পারবে না। জরুরি নির্গমন সিঁড়ি রাখা হয়নি, যাতে প্রয়োজনে ছাদে উঠে ওই পথ দিয়ে বের হওয়া যায়। যেসব কর্মী বিভিন্ন ভবনে কাজ করছেন, তাঁদের অগ্নিনির্বাপণের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। অবিলম্বে ফায়ার সার্ভিসকে এনগেজ করা প্রয়োজন। লিফটগুলো রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। লিফটে আটকে পড়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রী বাহাদুর, আপনি অ্যালোটিদের সঙ্গে কথা বললে সমস্যার গভীরতা বুঝতে পারবেন।
পূর্তমন্ত্রী কোনো প্রটোকল ছাড়া এবং রাজউক কর্মকর্তা ছাড়া এ এলাকায় এলে প্রকৃত তথ্য পাবেন। তিনি সব সময় সব ‘সত্য’ জানতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। একটি ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ যদি অব্যবস্থাপনা ও খামখেয়ালির কারণে ‘ব্যর্থ’ (?) হয়ে যায়, বর্তমান পূর্তমন্ত্রীর জন্য তখন ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে না। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রীর এই অগ্রাধিকার প্রকল্প সফল হোক। এ জন্য পূর্তমন্ত্রীর একক উদ্যোগই বড়। সব সময় রাজউকের ওপর নির্ভর করলে সফলতা পাওয়া যাবে না। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল উঁঁচু ভবনগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। রাজউকের কাজে শৈথিল্য আছে। ডেভেলপারদের কাজে ত্রুটি রয়েছে। এগুলো দেখা দরকার। ৭৯টি ভবনের বিশাল প্রকল্পকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
তিন.
উত্তরের মেয়র ১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি ভবনের ‘ফায়ার সেফটি’ ও ‘বিল্ডিং সেফটি’র কাগজপত্র চেয়েছেন। এটি পেয়ে তিনি কী করবেন, আমি জানি না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, রাজউকের কাছে প্রতিটি ভবনের তালিকা রয়েছে, যেটি অবৈধভাবে বর্ধিত করা হয়েছে। এখন আর সময় ক্ষেপণ করার সুযোগ নেই। রাজউক দ্রুত ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে বর্ধিতাংশ ভেঙে ফেলুক। এর আগেও সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, ঢাকা শহরে রাজউকের অনুমোদিত নকশা উপেক্ষা করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ নিজ ভবন বর্ধিত করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজউক তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রভাব রাজউকের ভেতরে অবৈধ চক্রের কর্মকাণ্ড, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নির্লিপ্ততা ইত্যাদি কারণে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে। আর সুযোগসন্ধানীরা এটিকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। যারাই অন্যায় করে ‘ফায়ার সেফটি’ না মেনে, ‘বিল্ডিং কোড’ অনুসরণ না করে, হাইরাইজ ভবন নির্মাণ করেছে, তারা সবাই অপরাধী। এই অপরাধের বিচার হওয়া উচিত। না হলে একটির পর একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে থাকবে।
বর্তমান পূর্তমন্ত্রী এর ব্যতিক্রম—আমরা এমনটিই দেখতে চাই। তাঁর ওপর আস্থা রাখতে চাই। প্রভাবশালীদের ‘চাপে’ তিনি মাথা নত করবেন না। এই বিশ্বাসটুকু রাখতে চাই। তাঁর ভূমিকার কারণে রাজউকে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হোক। সাবেক কোনো রাজউক চেয়ারম্যানের শৈথিল্য কিংবা অদক্ষতার কারণে এফআর টাওয়ারের মালিক ও ডেভেলপাররা যদি কোনো ‘সুযোগ’ নিয়ে থাকে, তাদের অবশ্যই আইনের আশ্রয়ে আনা হোক। সেই সঙ্গে অসাধু রাজউক কর্মকর্তারাও যেন মাফ পেয়ে না যান সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের জন্য ‘ওয়েক আপ’ ফল। এখনই জেগে ওঠার সময়। হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। প্রয়োজনে আইনজীবীরা জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। ডেভেলপার কম্পানি আর ভবনের মালিক এই অর্থ পরিশোধ করবেন। শৈথিল্য, কাজের গাফিলতি, দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন যে ঢাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের কত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, বনানীর অগ্নিকাণ্ড এর সর্বশেষ প্রমাণ। আমরা চাই রাজউক দ্রুত ‘অ্যাকশনে’ যাক। আর ‘হত্যাকাণ্ডের’ অভিযোগকারী মন্ত্রী রাজউকের এই কাজ ‘সুপারভাইজ’ করবেন

0 comments:

Post a Comment