রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস, হানটিংটনের তত্ত্ব ও প্রসঙ্গ কথা

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রয়াত অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হানটিংটনের তত্ত্বের (সভ্যতার সংকট) কি আদৌ কোনো মিল আছে? ১৯৯৩ সালে অক্সফোর্ডের সাবেক এই অধ্যাপক একটি প্রবন্ধ লিখে (The clash of civilization : The next Pattern of conflict, Forign Affairs, Summer, vol. 72, I 1993, Page.-22-28) ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। হানটিংটন পরে এটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেন। হানটিংটনের তত্ত্বের মূল কথা ছিল সভ্যতার দ্বন্দ্ব, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থা বিকশিত হবে। তিনি আটটি সভ্যতার কথা বলেছিলেন, যার মধ্যের দুটি নয়া বিশ্বব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেবে। তিনি যেসব সভ্যতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা সভ্যতা (খ্রিষ্টীয় সভ্যতা), কনফুসিয়াস, জাপানিজ, ইসলাম, হিন্দু, স্লাভিক-অর্থোডক্স, লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান সভ্যতা। হানটিংটন মনে করতেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে সিভিল জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে ওপরে উল্লিখিত আটটি সভ্যতার ছত্রছায়ায় একত্র করবে। তবে তিনি অর্থনৈতিক শক্তি জোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তার মতে, অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ করবে, যদি সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় বন্ধনটা অটুট থাকে। হানটিংটন আরও লেখেন,‘Nation states will remain the most powerful actors in world affairs, but the principle conflicts of global politics will occur between nations and groups of different civilizations’.হানটিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা বললেও চূড়ান্ত বিচারে দুটি সভ্যতা তথা ধর্মের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন (খ্রিষ্টীয় সভ্যতা বনাম ইসলাম), যা একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

হানটিংটন তার তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন আজ থেকে ২৬ বছর আগে। ওই সময় তার তত্ত্ব ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অনেকেই তার তত্ত্বের সমালোচনা করেছিলেন তখন। একাধিক প্রবন্ধ ও গল্পও রচিত হয়েছিল তার তত্ত্বের বিপরীতে। হানটিংটন আজ বেঁচে থাকলে খ্রিষ্টধর্মকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস কিংবা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকে তিনি কীভাবে বিশ্নেষণ করতেন, আমি জানি না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তার তত্ত্ব উপস্থাপনের পরপরই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ৯/১১-এর মতো ঘটনা (নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা, ২০০১)। আর ৯/১১-এর মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা। কার্যত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' আজ ১৭ বছর পরও চলছে। এরই মাঝে যোগ হয়েছে ট্রাম্পের উত্থান ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও ইসলাম-বিদ্বেষের ধুয়া তুলে ট্রাম্প ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। হানটিংটনের ধারণার (খ্রিষ্টীয় মতবাদ বনাম ইসলাম) সঙ্গে ট্রাম্পের চিন্তাধারার রয়েছে অদ্ভুত মিল। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ব কিংবা ইসলামবিদ্বেষ যে কত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তার সর্বশেষ প্রমাণ আমরা পেলাম জনৈক উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ ব্রেনটন টারেন্ট কর্তৃক ৫০ জন মুসলমানকে মসজিদে ঢুকে হত্যা করায়। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'- এ টার্গেট করা হয়েছে মুসলিম বিশ্বকে তথা ইসলাম ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়কে। কিন্তু উগ্র শ্বেতাঙ্গ ডানপন্থিদের উত্থান ও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে কম।  esri terrorist attacks Ges Peace Tech Lab শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত (২০১৯) আমাদের ৫৪০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর দিয়েছে, যার অনেকটির সঙ্গেই জড়িত রয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা। তবে এটাও সত্য, তথাকথিত ইসলামের নামে ইসলামিক স্টেট কিংবা নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম হয়েছে, যারা ইসলামের নামে এখনও মানুষ হত্যা করে চলেছে। মেয়েদের যৌনদাসী বানানোর কাহিনী সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। এদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের আদৌ কোনো মিল নেই।

হানটিংটন তার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য কিংবা শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসকে কতটুকু উসকে দিয়েছেন, এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা বিশ্বকে শুধু অস্থিতিশীল করেনি বরং বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই পরিস্থিতি থেকে বিশ্ব আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাকর্ম এখানে উল্লেখ করতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানটি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করে। তাদের প্রতিবেদনের কয়েকটি দিক- ১. 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর ফলে এখন পর্যন্ত চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন (যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি); ২. যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৯৫০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন; ৩. ২১ মিলিয়ন মানুষ (ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া) যুদ্ধের কারণে দেশান্তর হয়েছেন; ৪. যুক্তরাষ্ট্র ৭৬টি দেশে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে; ৫. ইরাক, আফগানিস্তান আর সিরিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আগামী ৪০ বছরে এই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী মানুষকে এই অর্থ বহন করতে হচ্ছে; ৬. যুদ্ধের খরচ মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। সাধারণ মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না; ৭. ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়া অথবা লিবিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। চিন্তা করা যায়- যুক্তিহীন এই যুদ্ধের পেছনে খরচ হয়ে গেছে ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন (১০০০ বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন) ডলার। এই বিপুল অর্থ দিয়ে কত চাকরির ব্যবস্থা করা যেত? স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেত সবার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে (পাঠক David Vine-Gi MÖš’ Base Nation : How U.S. Military Base abroad Harm America and the World পড়ে দেখতে পারেন)।

মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' আর ট্রাম্পের 'শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য' ধারণা একই সূত্রে গাঁথা; যার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় হানটিংটনের 'সভ্যতার সংকট' ধারণায়।

খ্রিষ্টীয় মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, ইসলাম ধর্মকে 'সন্ত্রাসী ধর্ম' (?) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে। এসব শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মসজিদে হামলা চালিয়ে সাধারণ মুসল্লিদের হত্যা করেছে। একাধিক সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্মও হয়েছে; যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন টারেন্ট 'ব্ল্যাক সান' বা 'কালো সূর্য' নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ওরা নব্য নাৎসি। এই নব্য নাৎসিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হচ্ছে। এরা নাৎসি মতবাদকে গ্রহণ করেছে, নাৎসি মতবাদকে আদর্শ হিসেবে মানছে। এমনকি তাদের সিম্বলও গ্রহণ করছে। এই নাৎসিবাদী সংগঠনগুলো এখন সভ্যতার প্রতি একধরনের হুমকি। ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া কমব্যাট-১৮ (Combat-18) নামে একটি সংগঠনের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া উগ্র কট্টরপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী এই সংগঠনটির শাখা এখন ইউরোপের ১৮টি দেশে সংগঠিত হয়েছে। এদের মূল আদর্শ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ববাদ, ইসলামবিরোধী ও শক্তিশালী একক নেতৃত্ব। এদের রাজনীতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অভিবাসী প্রসঙ্গটি। ২০১৫-১৬ সালে ইউরোপে ব্যাপক সংখ্যক সিরীয় অভিবাসী আসায় পুরো ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল প্রায় ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে জার্মানিতে আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বে প্রশংসিত হলেও তিনি বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান এই অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে ইউরোপে আগমনকে কেন্দ্র করে কট্টরপন্থি ডানপন্থি দলগুলো সেখানে শক্তিশালী হয়। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালিতে তারা এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে জার্মানিতে উগ্র নব্য নাৎসি সংগঠন 'অলটারনেটিভ ফর জার্মানি' পার্টি তৃতীয় স্থান অধিকার করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এটা ছিল একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। একসময় একেবারেই অপরিচিত এই দলটি এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। তারা যদি পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতার স্বাদ পায়, তাহলে ইউরোপে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। শুধু জার্মানির কথা কেন বলি- ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান, ইতালিতে নর্দান লীগের ক্ষমতার অংশীদার, হাঙ্গেরিতে 'জাম্বিক' কিংবা নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট ((Nordic Registance Movement) পুরো নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক) যেভাবে নব্য নাৎসি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড বিস্তার লাভ করছে, তা যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষের জন্য চিন্তার কারণ। এরা ইউরোপে 'হেইট ক্রাইম'-এর জন্ম দিয়েছে এবং লোন উল্কম্ফ' (Lone Wolf) বা একক সন্ত্রাসী হামলার জন্ম দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। উগ্র এই সংগঠনগুলো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।


ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ড আমাদের দেখিয়ে দিল শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদ কীভাবে সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে এরা বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্থিতিশীল বিশ্বের জন্য এ ধরনের ঘটনা কোনো ভালো খবর নয়
Daily Samakal
27.03.2019

1 comments: