দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত সোমবার যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তা
কিছু প্রশ্ন রেখে গেলেও, যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই
ডাকসু কতটুকু কার্যকর হবে? ডাকসুর ভিপি পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের
নেতা নুরুল হক নুরুর বিজয় ও ছাত্রলীগ কর্তৃক এই ফলাফল না মানা ও নুরুকে
বহিষ্কারের দাবি করা ডাকসুর ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডকে এখনই প্রশ্নের মুখে ঠেলে
দিয়েছে। যদিও ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদসহ ২৫টি পদের একটি বাদে
বাকি সব পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৮টি হলের
১২টিতেই ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ছয়টি হলে ভিপি হয়েছেন
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় আর অনলাইন সংবাদপত্রগুলোতে
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের শুধু হতাশার
মধ্যেই ফেলে দেয়নি, বরং নির্বাচনব্যবস্থার ওপরও রেখে গেছে একটি ‘কালো দাগ’।
নির্বাচনব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বোধ হয় আর থাকল না।
ডাকসু নির্বাচনটি ভালো হবে—এ রকম একটা প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু অভিযোগ উঠল ভোট কারচুপির। কুয়েত মৈত্রী হলে পাওয়া গেল সিল মারা বিপুল ব্যালট। এই অভিযোগে হলের প্রভোস্টকে বহিষ্কার করা হলো। নিয়োগ দেওয়া হলো নতুন একজন প্রভোস্টকে। রোকেয়া হলে ব্যালট বাক্স নিয়ে লুকোচুরির খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো, ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকল কিছুক্ষণ। ছাত্রলীগ বাদে যারা ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে—স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট, ছাত্রদল, কিংবা ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, সবাই ডাকসু নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের ডাক দিয়েছে। সোমবার সারা দিন বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর ছাত্র ধর্মঘটের ডাকও এসেছে বিক্ষোভকারী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। মিডিয়ায় উপ-উপাচার্যের বক্তব্য এসেছে এ রকম—‘আমরা এ দায় এড়াতে পারি না।’ আর চিফ রিটার্নিং অফিসারের বিব্রত হওয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। যদিও কোনো অভিযোগই স্বীকার করলেন না ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। জানালেন, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আচরণে তিনি বিস্মিত। ছাত্ররা গণতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে, তাতেই তিনি খুশি। আর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ছাত্রলীগবিরোধী নীতি নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।’ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী গোলাম রব্বানী বলেছেন, কুয়েত মৈত্রী হলে উদ্ধার হওয়া ব্যালট ভুয়া। রব্বানীর বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা আমরা তা জানি না। এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি নিশ্চয়ই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবে। তবে গণমাধ্যমের কর্মীরা জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ব্যালটগুলো (কুয়েত মৈত্রী হল থেকে) আসল এবং সেখানে চিফ রিটার্নিং অফিসারের স্বাক্ষর ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচনেও আমরা দোষারোপের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করলাম। কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালট ভর্তি বাক্স পাওয়া গেছে। রোকেয়া হলে তিনটি ব্যালট বাক্স দেখানোর কথা ছিল, তা দেখানো হয়নি। এ সবই বাস্তবতা। এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। উদ্ধার হওয়া ব্যালটের কারণেই প্রভোস্ট অপসারিত হলেন! আমি মনে করি শুধু তাঁকে অপসারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁকে আরো কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেননি।
আমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছিল পুরো জাতিকে দেখানো যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করবে ভোট সংস্কৃতিতে জালিয়াতির সুযোগ এখানে অন্তত নেই। কিন্তু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কলঙ্কিত হলো। এটা সত্য শুধু কুয়েত মৈত্রী হল কিংবা রোকেয়া হলকে কেন্দ্র করে অভিযোগগুলোই বেশি। কিন্তু অন্য হলগুলোর ক্ষেত্রে অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম। তার পরও এটা হওয়া উচিত ছিল না। ছাত্রলীগ নেতাদের উচিত ছিল বিরোধী প্রার্থীদের দোষী না করে প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত দাবি করা। নির্বাচন হলেই ভোট কারচুপি হবে, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অভিযুক্ত করবে—রাজনীতির এই যে সনাতন চিত্র, এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। যাঁরাই অতি উৎসাহী হয়ে এই কাজগুলো করেছেন তাঁরা পরোক্ষভাবে সরকারেরও ক্ষতি করলেন। উপ-উপাচার্য স্বীকার করেছেন তাঁরা এই দায়ভার এড়াতে পারেন না। উপ-উপাচার্য সামাদ সাহেব কবি মানুষ। কিন্তু তাঁর স্বীকারোক্তিতে পরিবেশ কি বদলানো যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে! ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা যেত, তাতে তো ক্ষতির কিছু ছিল না। যুক্তি হিসেবে ধরে নিই যদি বিরোধী ছাত্রসংগঠন ডাকসু নির্বাচনে সব আসনে বিজয়ীও হতো (?), গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা হতো আমাদের জন্য বড় পাওয়া। অতি উৎসাহীরা সরকারকেও যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, ডাকসু নির্বাচন এর বড় প্রমাণ।
ডাকসু নির্বাচনের কিছু প্লাস পয়েন্ট, কিছু মাইনাস পয়েন্ট রয়েছে। নির্বাচনে কোনো সহিংসতা হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল, শঙ্কা ছিল সহিংসতা হতে পারে। ভালো খবর, তেমন কিছুই হয়নি। ভালো হোক, মন্দ হোক ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে। সরকারি ছাত্রসংগঠনের প্রভাব বেশি থাকায় তারা নির্বাচনে ভালো করেছে—এটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হলগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বিজয়ী হয়েছেন—এই বিষয়টিকেও হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রনেতা পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ যাঁরা ডাকসুতে বিজয়ী হলেন, প্রত্যাশা থাকল তাঁরাই জাতীয় রাজনীতিতে আসবেন এবং রাজনীতির গুণগত মানে পরিবর্তন আনবেন। নির্বাচিত ভিপির কাছ থেকেও প্রত্যাশা বাড়ল অনেক। কিন্তু মাইনাস পয়েন্ট অনেক। এক. যে শঙ্কা ও আশঙ্কা নির্বাচনের আগে সংবাদপত্রগুলো করেছিল (কালের কণ্ঠ : শঙ্কা থেকে উত্তেজনা), তা অনেকটাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। দুই. কুয়েত মৈত্রী হল ও রোকেয়া হলে ভোটের অনিয়ম বন্ধে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতা পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যে অভিযোগটি উঠেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনকে বিজয়ী করার জন্যই এই নির্বাচনের আয়োজন করেছে’—এই অভিযোগটি এখন আরো শক্তিশালী হবে। তিন. এই নির্বাচন ডাকসুর মর্যাদাকে আরো ক্ষুণ্ন করল। চার. সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন এখন প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন আয়োজন করতে চাইবে। ডাকসুতে ও হলগুলোতে তাদের বিজয় সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতাদের আরো উৎসাহ জোগাবে দ্রুত বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচন আয়োজন করতে। তবে ডাকসুর অভিজ্ঞতার কারণে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হবে না। পাঁচ. ডাকসু নির্বাচনে বিএনপিপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের ভরাডুবি চোখে লাগার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব ছিল। ছাত্রদল সমর্থকরা ছিল নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়ে হলের ‘সিট’ হারানোর ঝুঁকিতে ছিল। ছাত্রদলের অবর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনো কোনো হলে ভিপি পদে পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাই তাঁদের বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে। তাঁরাই এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অন্যতম শক্তিরূপে আবির্ভূত হবেন।
ডাকসু নির্বাচনে কিছু অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজে ‘বিব্রত’ হয়েছেন মন্তব্য করে দায় এড়াতে চাইছেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মন্তব্য করেছে—‘এভাবে ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি’। সরকারি দলের কাছ থেকে আসবে উল্টো বক্তব্য। তবে একটা জিনিস আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে, এত কিছুর পরও কোটা আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নুরু ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছাত্রলীগের প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান অনেক। তাঁর বিজয়ে অনেক ইতিবাচক দিকও আছে। শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেছে। ছাত্রনেতারা শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবেন—সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। নুরুল হক কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় একাধিকবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। এমনকি ডাকসু নির্বাচনের সময়ও তিনি রোকেয়া হলে ছাত্রলীগের নারী কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একপর্যায়ে তাঁরা ভোট বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে রোকেয়া হলের প্রভোস্টকে লাঞ্ছনা করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের কর্মীরা ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নুরুর বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করায় একটা আশঙ্কার জন্ম হয়েছে যে নির্বাচিত ভিপি নুরুল হককে আদৌ কাজ করতে দেওয়া হবে না। এটা হওয়া উচিত নয়। তাঁকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। ছাত্রলীগের নেতাদের উচিত বিষয়টি ভাবা, কেন তাঁরা ভিপি পদে হারলেন। এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির তুলনা করাও ঠিক হবে না। তবে জাতীয় নেতারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যত কম মন্তব্য করবেন, ততই মঙ্গল। উভয় পক্ষেরই জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া ভালো। ছাত্রলীগ যদি ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রাখে, তাহলে ডাকসু নির্বাচন অর্থহীন হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা যাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে, তাঁদের সবার সম্মান জানানো উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নিশ্চয়ই ডাকসু নির্বাচন থেকে কিছু শিখেছে। দীর্ঘদিন পর তারা এই নির্বাচনের আয়োজন করল। তারা নিশ্চয়ই তাদের এই অভিজ্ঞতাকে আগামী দিনে কাজে লাগাবে। দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচন হয়েছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করে যাবেন—এই প্রত্যাশা সবার।
Daily Kalerkontho
13.03.2019
0 comments:
Post a Comment