রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা

Image result for Indo Pak recent conflictপাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোটের কাছে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান হামলার পর যে প্রশ্নটি এখন বহুল আলোচিত, তা হচ্ছে চতুর্থবারের মতো পাকিস্তান ও ভারত কি আবারও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে? গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর ৪৪ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এই আত্মঘাতী বোমা হামলার দায়ভার স্বীকার করেছিল পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ। আর এর প্রতিশোধ হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের ২৩ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। যদিও ভারত দাবি করেছে, তারা ৩০০ জঙ্গিকে হত্যা করেছে। কিন্তু পাকিস্তান বলেছে, ওই বিমান হামলায় মাত্র একজন আহত হয়েছে। এই বিমান হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। এরই মধ্যে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় সেনাছাউনিতে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নিউজ এইটিনের খবর অনুযায়ী ‘কৃষ্ণা’, নওশেবা, বালাকোট ও মেন্দার সেক্টরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
এখানে বলা ভালো, সীমান্তে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বরাবর ভারত-পাকিস্তান অস্ত্রবিরতি সমঝোতা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভারতের অভিযোগ, এরপর অন্তত তিন হাজারবার পাকিস্তান অস্ত্রবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। অতীতে প্রতিবেশী এই দেশ দুটির সীমান্তে মাঝেমধ্যে গুলিবিনিময় হলেও, এই প্রথমবারের মতো ভারত বিমান হামলা চালিয়েছে। তবে এটা এখন অবধি নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ঘটনার পরপরই জাব্বা টপ পাহাড়ের আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে ফেলেছে এবং কাউকেই সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ওই ঘটনায় কত মানুষ মারা গেছে তা-ও স্পষ্ট নয়। পাকিস্তান কিভাবে এই বালাকোট হামলার প্রত্যুত্তর দেবে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরাইশি বলেছেন, এই ‘হামলার’ সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে গড়াবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। অতীতে তিন-তিনবার এই দেশ দুটি পরস্পর যুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও ১৯৯৯ সালে কারগিলে দেশ দুটি সীমিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, যাকে ঠিক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বলা যাবে না।
মূলত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে কাশ্মীর নিয়ে বড় ধরনের সংকটের জন্ম হয়। ভারত বিভক্তির সময় (১৯৪৭) তৎকালীন কাশ্মীরের শাসক রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি একটি চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে অভিযোগ আছে, যে শর্তে রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, ভারত সেই শর্ত থেকে পরে সরে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরের কিছু স্বাধীনতাকামী পাকিস্তানের সমর্থন নিয়ে কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে নিজেদের ভারত থেকে আলাদা করে। এই অংশটি আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত এবং পাকিস্তানের একটি প্রদেশ এখন। তবে কাশ্মীরের আরেকটি অংশ আছে—সিয়াচেন গ্লেসিয়ার ও আকসাই চীন, যা চীন নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করছে। পাকিস্তান এই অঞ্চলে তাদের অংশ চীনকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারত এখনো এ অঞ্চলটি তাদের নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। সিয়াচেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধের খবরও আমরা জানি। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তানবিরোধী জনমত না থাকলেও ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে প্রচণ্ড ভারতবিরোধিতা রয়েছে। এই ভারতবিরোধিতাকে কেন্দ্র করে সেখানে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা এই অঞ্চলটিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। পাকিস্তান এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই কাশ্মীর বারবার উত্তেজনার জন্ম দিচ্ছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা একাধিকবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৬০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ২০০৩ সালে দেশ দুটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করলে দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাকিস্তান ওই সময় কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থসহায়তা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ২০১৪ সালে ভারতে মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। নওয়াজ শরিফ নিজে দিল্লি গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এর আগে বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি লাহোরে বাসে করে গিয়ে ‘বাস কূটনীতি’ শুরু করেছিলেন। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায় জঙ্গিদের আত্মঘাতী তৎপরতার কারণে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা যে এই প্রথম, তা নয়। বরং এর আগেও একাধিকবার পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গিরা ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। পাঠক, নিশ্চয়ই উরি-পাঠানকোটের ঘটনা মনে করতে পারেন। উরি-পাঠানকোটের জঙ্গি হামলার জের ধরেই পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা হলো।
২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উরি সামরিক ছাউনিতে জইশ-ই-মোহাম্মদের জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছিল। ওই আত্মঘাতী হামলায় ২৩ জন ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছিল। আত্মঘাতী হামলায় চার জঙ্গিও মারা গিয়েছিল। ওই হামলার পর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, ওই হামলার ১০ দিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী জঙ্গিদের ঘাঁটিতে (আজাদ কাশ্মীর) ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা আজাদ কাশ্মীরে প্রবেশ করে জঙ্গিঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে অনেক জঙ্গিকে হত্যা করে। ওই হামলায় আরেকটি জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাও তাদের দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছিল। ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার খবরও অনেকে স্মরণ করতে পারেন। ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল ওই হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করলেও ধারণা করা হয়, ওই জঙ্গিগোষ্ঠীটি জইশ-ই-মোহাম্মদেরই একটি উপদল।
ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গিরা যে কত তৎপর, তার প্রমাণ ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টে জঙ্গি হামলা। লস্কর-ই-তৈয়বা এই জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল। জইশ-ই-মোহাম্মদও এই হামলায় অংশ নেয়। ওই হামলায় ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছিল, যার মধ্যে ছয়জন ছিল পুলিশ সদস্য। ওই সময় পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছিল। জঙ্গিরা একে-৪৭ রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তারা যে কত শক্তিশালী ও সংগঠিত, তার প্রমাণ ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলসহ একাধিক স্থানে একসঙ্গে জঙ্গি হামলা। জঙ্গিরা প্রায় তিন দিন তাজ হোটেলের গেস্টদের জিম্মি করে রেখেছিল। প্রায় ১০টি স্থানে একই সময় পরিচালিত হামলায় ১৬৬ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিল। হামলায় অংশ নেওয়া আজমল খাসাবের ছবি ওই সময় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। পরে বিচারে খাসাবের ফাঁসি হয়েছিল।
সুতরাং বোঝাই যায়, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলাই একমাত্র জঙ্গি হামলা নয়। জঙ্গিরা মূলত জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এরা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাকিস্তানের বিভিন্ন সূত্র থেকে এরা অস্ত্র ও অর্থ পেয়ে থাকে। এদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—সন্ত্রাসী তৎপরতার মধ্য দিয়ে ভারতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। সুতরাং আজ ভারতীয় বিমানবাহিনী যখন বালাকোটে জঙ্গিঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়, আমি তাতে অবাক হইনি। বরং এটাই যুক্তিযুক্ত। ভারতে জঙ্গি হামলা বন্ধ হওয়া উচিত। এসব জঙ্গি হামলার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় উগ্রবাদীরা এখন দাবি জানাচ্ছে পাকিস্তান আক্রমণের। এখন যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় (?), তাহলে তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দুটি বড় দেশের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এমনিতেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। পাকিস্তানের আরেকটি যুদ্ধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এই যুদ্ধ পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। একটি ‘যুদ্ধ’ হয়তো নরেন্দ্র মোদির অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। এপ্রিল-মে মাসে সেখানে লোকসভার নির্বাচন। এখন ‘যুদ্ধ’ হলে তা মোদির অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। ভারতে দারিদ্র্য আছে। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হবে।
কাশ্মীর উভয় দেশের জন্যই একটি রাজনৈতিক ইস্যু। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ইস্যুকে ব্যবহার করে আসছেন। ইমরান খানও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। সেনাবাহিনীর জন্য এটা একটা বড় ইস্যু। কাশ্মীর ইস্যু ব্যবহার করেই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শক্তির ওপর বারবার ‘চাপ’ প্রয়োগ করে আসছে। সুতরাং এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে উত্তেজনা হ্রাস করা, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করা এবং জঙ্গিদের যেকোনো সমর্থন প্রদান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া। কাশ্মীরে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখাটা জরুরি। এমনকি কাশ্মীরের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপ করা যায় কি না, তা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা বিবেচনায় নিতে পারেন। প্রয়োজনে কাশ্মীরি নেতাদের ভারত ব্যবহার করতে পারেন। একটি স্থিতিশীল কাশ্মীর দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
Daily Kalerkontho
05.03.2019

0 comments:

Post a Comment