নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য দলীয় কার্যক্রম দ্বারা নিয়ত্রিত। অর্থাৎ তিনি যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত মানতে তিনি বাধ্য। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ১. কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে ...।' এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরের একটি দল আছে (গণফোরাম) এবং তিনি ওই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তিনি গণফোরাম থেকে পদত্যাগ করেননি এবং সংসদে এখন পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেননি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত তিনি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বরখেলাপ করেননি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে কোথাও লেখা নেই 'দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে' সংসদে যোগদানের কথাটি। তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন, এটা সত্য (সংসদে যোগ না দেওয়ার প্রশ্নে)। কিন্তু তিনি দল থেকে পদত্যাগও করেননি। এমনকি সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ভোটও দেননি। তিনি বিরোধী দলের আসনে বসেছেন এবং আমার ধারণা, গণফোরাম বা ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে সরকারের সমালোচনাও করবেন। এটা এখন আইনগত একটা ব্যাখ্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল যে, তিনি ৭০ অনুচ্ছেদের কতটুকু বরখেলাপ করেছেন!
তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ডাকসুর ভিপি ছিলেন। এর আগেও সাংসদ ছিলেন। বিষয়টি যে তিনি জানেন না, তা নয়। তিনি জানেন, বোঝেন। আমার ধারণা, তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করেই সংসদে যোগ দিয়েছেন। এমনও হতে পারে, আগামীতে তিনি আলাদাভাবে গণফোরামকে সংগঠিত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে গণফোরামের একটি অংশের প্রতিনিধি হয়ে তিনি তার সংসদ সদস্য পদ বহাল রাখবেন। তবে বিষয়টি যে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেল, তা স্পষ্ট। গণফোরাম তথা ঐক্যফ্রন্ট বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছে। কমিশন এখন একটি সিদ্ধান্ত নেবে। এই সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে। চাই কি, বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়াতে পারে। সুতরাং সুলতান মনসুরের বিষয়টি যে কালকেই সমাধান হয়ে যাবে, তেমন নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটাও সত্য, যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন, ওই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি 'আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না'। ৭০ অনুচ্ছেদে এ কথাটাও লেখা আছে।
সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন, কি পারবেন না- এই বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই তুলেছেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। এখন দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ 'কেনাবেচার' হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা 'বিক্রি' হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন- ৭০ অনুচ্ছেদে 'দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে' কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্ণ করবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে- রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও তা ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন।
সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তিনি কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী ৫ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষ দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষ দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিস্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয়, আমি অবাক হবো না। সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু নৈতিকভাবে তিনি 'পরাজিত' হয়েছেন। আওয়ামী লীগের 'রাজনৈতিক শত্রু' বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
সুলতান মনসুরের সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনায় আরও একটা প্রশ্ন সামনে এলো। আর তা হচ্ছে, গণফোরাম থেকে নির্বাচিত অপর সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানও কি সুলতান মনসুরকে অনুসরণ করবেন? সংবিধানের ৬৭(১) অনুযায়ী তিনি সময় পাবেন ৯০ দিন। সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে এই ৯০ দিন শুরু হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে মোকাব্বির খান শপথ না নিলে তিনি তার সংসদ সদস্যপদ হারাবেন। একই কথা প্রযোজ্য বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেও। তাদের সবার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হলে নিয়ম অনুযায়ী সেখানে উপনির্বাচন হবে। ঐক্যফ্রন্ট বিগত নির্বাচনে অনিয়মের দাবি তুললেও বড় কোনো আন্দোলনের ডাক দেয়নি কিংবা বড় কোনো জনমতও গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। দশম জাতীয় সংসদের মতো একাদশ জাতীয় সংসদও তার টার্ম শেষ করবে। এ ক্ষেত্রে আগামী ৫ বছর বিএনপি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না, সেটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। দলের নেত্রী এখন জেলে। তাকে আইনগতভাবে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারেনি বিএনপি। শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনেকের নামেই একাধিক মামলা। মামলা থেকে মুক্ত হননি বিএনপির নেতৃবৃন্দ। দল গোছানোর কাজটাও অসম্পূর্ণ। ফলে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বিএনপি হাঁটছে। কর্মীরা রয়েছেন বড় ধরনের বিভ্রান্তিতে। দলের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসছে না। এখন বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে যোগ না দিলেও সংসদ টিকে থাকবে, যেমনটি টিকে ছিল দশম জাতীয় সংসদ। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই এলো সুলতান মনসুরের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তটি। এতে করে সংসদ কতটুকু কার্যকর হবে, সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কতটুকু স্বীকৃত হবে- তা এক প্রশ্ন বটে। সংসদে একটি বিরোধী দল আছে। তাদের ব্যাপারে মানুষের এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সরকারি ছত্রছায়ায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি দলটিকে সত্যিকার অর্থে একটি বিরোধী দলে পরিণত করতে পারেনি। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একজন সুলতান মনসুর বিরোধী দলের আসনে বসলেও একটি 'বিতর্কের' মধ্য দিয়েই তিনি সংসদে যোগ দিলেন। তিনি চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে মনে হয় না।
Daily Samakal
16.03.2019
0 comments:
Post a Comment