রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর আমরা কতটুকু আস্থা রাখতে পারছি



৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১০ মার্চ ৭৮ উপজেলার ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মনসুর দলীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা সংসদে যাবে না। এখন সুলতান মনসুর গেলেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ছে। অথচ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য নির্বাচন হলো একটি অন্যতম ধাপ। কিন্তু সেই নির্বাচন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষের আগ্রহ যদি না থাকে, তাহলে তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না।
১০ মার্চ ৭৮ উপজেলায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। কেমন হলো এ উপজেলা নির্বাচন? সংবাদপত্রের ভাষ্য থেকেই বোঝা যায়, এ নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের পর এ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়নি। সংবাদপত্রের ভাষায়Ñ ‘পর্যাপ্ত আয়োজন, ছিল না তেমন ভোটার’ (প্রথম আলো)। জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা নির্বাচনও ছিল সরকারি দলের জয়জয়কার। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ৪১টিতে, বিদ্রোহীরা ১৯টিতে, বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা তিনটিতে বিজয়ী হয়েছেন (যুগান্তর)। কিন্তু এ নির্বাচন কি সুষ্ঠু হয়েছে? সংবাদপত্রের ভাষা অবশ্য সে কথা বলে না! কোথাও কোথাও অতিরিক্ত ভোটও পড়েছে (শাহজাদপুর)। রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে (সিরাজগঞ্জ)। প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে গ্রেপ্তার করে জেল দেওয়া হয়েছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে (কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার খবরও আছে। এর অর্থ এ নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। নির্বাচনের অপর নাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একজন অপরজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, শঙ্কামুক্তভাবে নির্বাচন হবে; কিন্তু তা হয়নি। এই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। সরকারি দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেশি থাকলেও নির্বাচনে রাতের বেলা সিল মারা, ব্যালট ছিনতাই, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো আশার কথা বলে না। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার নেই, কোথাও ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ঘুমিয়ে নিচ্ছেন, কোথাওবা ভোটকেন্দ্রের বাইরে রোদ পোহাচ্ছেনÑ এসবই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, সব কেন্দ্রে হয়তো এমনটি ঘটেনি। কিন্তু ‘উৎসাহ-উদ্দীপনার’ মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়, উপজেলা নির্বাচনে তেমনটি ছিল নাÑ এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। মানুষ ভোটের ওপর থেকে কি আস্থা হারিয়ে ফেলছে? এসব প্রশ্ন এখন উচ্চারিত হচ্ছে।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচন মানেই একটা জমজমাট আসর। প্রচুর লোকজন ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থাকে। ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় উভয় পক্ষ থেকে। কিন্তু এবার তেমনটি ছিল না। বিএনপির ‘তেমন অংশগ্রহণ’ না থাকায় নির্বাচনটি জমে ওঠেনি। বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনটি ভালো হয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে এর একটা প্রভাব যে উপজেলায় থাকবেÑ এটা সবাই অনুমান করেছিলেন। বাস্তব ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ভোট হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। আবার এরই মাঝে যখন ‘রাতের বেলায় সিল মারার ঘটনা’ ঘটে কিংবা ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়, এ ঘটনাকে আমরা যতই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলি না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনি সংস্কৃতির জন্য এটা খারাপ খবর। নির্বাচনি রাজনীতির জন্য আরেকটি খারাপ খবর হচ্ছে সুলতান মনসুরের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জোগদান। সুলতান মনসুর গণফোরামের সদস্য ও ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু গণফোরাম সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সংসদে যাবে না। কিন্তু সুলতান মনসুর গেলেন। এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার এ সিদ্ধান্ত আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। যদিও ৭০ অনুচ্ছেদ অতীতেও কার্যকর হতে দেখা যায়নি। তবে সুলতান মনসুরের সংসদে জোগদান বিতর্ক বাড়িয়েছে মাত্র।
সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন কী পারবেন না, এ বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নটিই তুলেছেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। এখন দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এ অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ ‘কেনা-বেচার’ হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা ‘বিক্রি’ হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সংসদ সদস্যদের ‘ক্রয়’ করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এ ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছেÑ রাজনীতির সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এ আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন।
সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তিনি কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী ৫ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয় আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেনÑ এটা সত্য। কিন্তু নৈতিকভাবে তিনি ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষ যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনটি দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু এ নির্বাচনটিও যে ‘ভালো’ হয়েছে, তা বলা যাবে না। এখন আমাদের রাজনীতিবিদদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কীভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনবেন। আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে এবং তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবে। এর যদি ব্যত্যয় ঘটে, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Alokito Bangladesh
13.03.2019

0 comments:

Post a Comment