‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ সাম্প্রতিক সময়কালে আলোচিত একটি শব্দ। কূটনৈতিক অভিধানে এই শব্দটি সম্প্রতি যোগ হয়েছে। সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয় এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো যখন কভিড-১৯-এর টিকা আবিষ্কারের জন্য এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তখনই ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’র ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
বলা হলো, তার বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন পরীক্ষার বিষয় আলোচনা। বাংলাদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভারত থেকে প্রথমে টিকা পাবে এমন কথাও বলা হলো। এর আগে বাংলাদেশ একটি চীনা কোম্পানি Sinovac Biotech Ltd.-কে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে তাদের উৎপাদিত টিকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে আমাদের জানিয়েছেন, ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে সিনোভ্যাককে সে দেশে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। আমরা এক লাখ ডোজ টিকা বিনামূল্যে পাব, তবে বাকি যা প্রয়োজন হবে, তা আমাদের কিনতে হবে। সিনোভ্যাক গত জুলাই মাসে চীনে তাদের তৃতীয় ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। ব্রাজিল ও আরব আমিরাতের মতো দেশও তাদের উৎপাদিত টিকা হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য অনুমতি দিয়েছে। চীনের পাশাপাশি ভারতও টিকা উৎপাদন ও বিপণনে সক্রিয় হয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে ৫০ লাখ করোনা প্রতিষেধকের টিকা তৈরির। তিনটি টিকা নিয়ে সেখানে কথা হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের ট্রায়াল চালাচ্ছে। এর বাইরে ভারতের ভারত বায়োটেক ও জাইডায় ফ্যাডিলাও প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়াল চালাচ্ছে। তবে ব্রিটেনে সাড়া জাগানো ফল মেলার পর ভারত সরকারের নজরে রয়েছে অক্সফোর্ডের প্রতিষেধকের ওপর। গত আগস্ট মাসে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া ঘোষণা করে যে, তারা বৈশ্বিক সংস্থা The Vaccine Alliance and Gates Foundation-এর সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অক্সফোর্ডের Astra Zeneca’s ChAdox1 nCov-19 (ভারতে নাম Covishield) ভারতে উৎপাদন ও সেই সঙ্গে তারা উন্নয়নশীল বিশ্বে তা বাজারজাত করবে। বাংলাদেশ এখান থেকে এই টিকাটি পাবে। এর দাম ধরা হয়েছে প্রতি ডোজ তিন ডলার হিসেবে ভারতীয় মুদ্রায় ২২৫ রুপি। তবে বাংলাদেশ কত টাকায় এক ডোজ টিকা কিনবে কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে কত টাকায় তা বিক্রি হবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা এ খাতে বরাদ্দ রেখেছে।চীন ও ভারতের পাশাপাশি রাশিয়াও করোনাভাইরাস টিকা আবিষ্কার এবং তা বিপণনে এগিয়ে এসেছে। সাইবেরিয়ার Vector Virology Institute ইতিমধ্যে Sputnik-v নামে একটি টিকা আবিষ্কার করেছে এবং তার হিউম্যান ট্রায়ালও সম্পন্ন হয়েছে। খোদ প্রেসিডেন্ট পুতিন এ কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ রাশিয়ার টিকাও ব্যবহার করতে পারে এমন কথাও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যে আমেরিকান কোম্পানি Novavax তাদের উৎপাদিত টিকা নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসতে চায়। তারা দ্বিতীয় হিউম্যান ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই টিকাটি বাজারে আনতে চান, যাতে করে সাধারণ ভোটারদের মন তিনি জয় করতে পারেন।
প্রায় এক বছর হতে চলল কভিড-১৯ মহামারীটি সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মহামারীটি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, তা বলা যাবে না। ৫ সেপ্টেম্বরের খবর করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৮,৭৮,৮০৬ জন, আর আক্রান্তের সংখ্যা ২,৬৭,৮৪,৮৩২ জন। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে, ১,৯২,১১১ জন। নতুন মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে মেক্সিকোতে, ৫২২ জন। আগামী শীতে, অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ‘দ্বিতীয় আরেকটি ওয়েভ’ আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংগত কারণেই তাই খুব দ্রুত টিকা আবিষ্কার এবং তার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী টিকার চাহিদা বাড়ছে। ফর্বস ম্যাগাজিন আমাদের জানাচ্ছে (১৬ জুন) ৯টি ওষুধ কোম্পানি এখন কভিড-১৯ টিকা তৈরিতে এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এই ৯টি কোম্পানির তৈরি টিকার ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ সম্পন্ন হয়েছে। তবে সবার তৃতীয় ট্রায়াল সম্পন্ন হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়াল হয়েছে। এর বাইরে আরও ১০০টি টিকার গবেষণা চলছে এবং এদের অনেকেই আগামীতে কভিড-১৯ উৎপাদনে নিজেদের জড়িত করবে। এই ৯টি কোম্পানি হচ্ছে, Consino Biologies, Johnson & Johnson, Pfizer, Moderne, Astra Zeneca PLC, GlaxoSmithkline, Sinovac, Novavax, Merck |
করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার এবং বিশ্বের সর্বত্র তা বিপণন করা একটা বিরাট ব্যবসা। বিশ্বের জনসংখ্যা (২০২০) এখন ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন, অর্থাৎ ৭৮০ কোটি মানুষের বসবাস এই গ্রহে। এদের সবাইকে টিকা দিতে হবে। ৭৮০ কোটি ডোজ টিকা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু টিকা গ্রহণ করেই এই মহামারী নির্মূল করা সম্ভব, যেমনটি বিশ্বে প্রত্যক্ষ করেছিল স্মলপক্স কিংবা কলেরা নির্মূল করে। সুতরাং কভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার একটা বিশাল ব্যবসা। এজন্য মারণব্যাধি এসব ওষুধ/টিকা আবিষ্কার ও গবেষণার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়। The Intercept জার্নালের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের National Institute of Health ১৯৩০ সালের পর থেকে প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বিভিন্ন মারণব্যাধির ওষুধ আবিষ্কার করতে। সরকারি অর্থে পরিচালিত গবেষণা ড্রাগ কোম্পানিগুলো ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদনে। যেমন নোভারটিস (Novartis) এইচআইভির ওষুধ AZT এবং ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত Kymriah উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এটা তারা বিক্রি করছে ৪,৭৫,০০০ ডলারে (ওই, ১৪ মার্চ ২০২০)। Gilead Sciences নামে একটি কোম্পানি হেপাটাইটিস ‘সি’-র ওষুধ Sofosbuvir বিক্রি করছে এক হাজার ডলার করে (প্রতি পিল)। এই কোম্পানি প্রথম তিন বছরে আয় করেছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। Axios নামে একটি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সেক্টরের আয়ের শতকরা ৬৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের লবিং খুব শক্তিশালী, যে কারণে তারা প্রচুর আয় করতে পারে। ২০১৯ সালে ড্রাগ কোম্পানিগুলো লবিংয়ের পেছনে ব্যয় করেছে ২৯৫ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ কোম্পানিগুলো এত শক্তিশালী যে, তারা এখন হোয়াইট হাউজের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সে অন্তর্ভুক্ত। ওষুধ কোম্পানি Eli lilly’র Azar এবং Gilead’র পক্ষ হয়ে Joe Grogan এখন টাস্কফোর্সে সক্রিয়। সুতরাং আগামীতে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হবে এবং তার অনুমোদনও দেওয়া হবে এসব লবিস্টদের কারণে এবং উচ্চমূল্যে তা বিক্রি হবে। আর স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো এ থেকে ফায়দা ওঠাবে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মানুষের (বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের) ‘হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্ড’ নেই। ফলে তারা করোনাভাইরাসের টিকা প্রথম দিকে পাবে না।
সুতরাং মারণব্যাধি কভিড-১৯-এর টিকা বিনামূল্যে বিতরণের একটি দাবি তুলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের ১৪০ জন নেতা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ গেল মে মাসে একটি উন্মুক্ত আবেদন করেন, যাতে তারা করোনাভাইরাসের টিকাকে ‘Peoples Vaccine’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা বিনামূল্যে বিতরণের আহ্বান জানান। তারা কভিড-১৯ টিকাকে পেটেন্টমুক্ত রাখারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা বিনামূল্যে আদৌ সরবরাহ হবে, তা মনে হয় না। ফ্রান্সের বড় ড্রাগ কোম্পানি Sanofi-এর প্রধান মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস টিকা আবিষ্কারে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, সেহেতু তাদের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। গত মার্চ মাসে জার্মান পত্রিকা Die Welt am Sonntag এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জার্মান বায়োটেক কোম্পানি Cure Vac-কে তাদের উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকার জন্য এক বিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছিলেন, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র ওই টিকাটি এককভাবে নিজে উৎপাদন করতে পারে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলই- করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো তা বিনামূল্যে পাবে কিনা? ‘হু’ একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ‘হু’র সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কের অবনতি ও বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ নির্মূলে ‘হু’র যেকোনো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের না থাকার সিদ্ধান্ত ও সর্বোপরি ‘হু’ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া সব মিলিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এগুলো খারাপ সংবাদ। কভিড-১৯ নির্মূলে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা দরকার। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জরুরি। ১৯৬৭ সালে ‘হু’ বিশ্ব থেকে স্মলপক্স নির্মূলের উদ্যোগ নিয়েছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তখন একসঙ্গে কাজ করেছিল। এর আট বছর পর স্মলপক্স বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়েছিল। সুতরাং আজ যদি করোনাভাইরাসের টিকা পেটেন্ট ফ্রি করা না যায়, যদি বিনামূল্যে সরবরাহ করা না যায়, তাহলে কভিড-১৯ নির্মূল নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাবে
Desh Rupantor
12.9.2020
ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDelete