ব্যবধানটা ২৭ বছরের। ১৯৯৩ থেকে ২০২০। দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জড়িত হলেন মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায়! ১৯৯৩ সালে উদ্যোগী হয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে শান্তি আলোচনা শেষ হয়েছিল। এই আলোচনার ফলে ১৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল ও পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। আর এর রেশ ধরে ১৩ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে ইসরায়েল ও পিএলও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের একটি ছবি- মাঝখানে বিল ক্লিনটন, তার ডান পাশে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী রাবিন ও বাম পাশে ইয়াসির আরাফাত। এই ছবি একটি ঐতিহাসিক ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ওই সময়। আর ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে আরেকটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। উপস্থিত থাকলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আর আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করায় মধ্যপ্রাচ্যে কি আদৌ শান্তি আসবে? দুটি আরব দেশ- আরব আমিরাত ও বাহরাইনের ইসরায়েলকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে কি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের সূচনা হলো? এখন সৌদি আরব কি আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? এসব প্রশ্ন এখন বারবার উচ্চারিত হবে। লন্ডনের ইকোনমিস্ট প্রশ্ন তুলেছে- এর পর কে? অর্থাৎ কোন আরব রাষ্ট্র এর পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে? ওমানের দিকে চোখ রাখতে বলেছে সংবাদ সাময়িকীটি। ২০১৮ সালে ওমানের প্রয়াত শাসক সুলতান কাবুস ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ওমানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সুদান ও মরক্কোর দিকেও দৃষ্টি আছে অনেকের। সুদানের অন্তর্বর্তী নেতা আবদেল ফাতাহ আল বুরহান চলতি বছর উগান্ডায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন এবং দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবেই হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক রয়েছেন, যারা এসেছেন মরক্কো থেকে। মৌরিতানিয়া ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে এক ধরনের ‘সম্পর্ক’ রক্ষা করেছে। ওই দেশটি ইসরায়েল-আরব আমিরাত সম্পর্ককে স্বাগত জানিয়েছে। আর সৌদি আরবের অলিখিত ‘মূল শাসক’ ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সুলতানের স্ট্র্যাটেজি অনেকে জানেন। ‘ইরানভীতি’ তাকে বাধ্য করছে ইসরায়েলের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক করতে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা, ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো এখন সৌদি আরবে সক্রিয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে জর্ডান স্বীকৃতি দিয়েছিল ইসরায়েলকে। এর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক রচিত হলেও ফিলিস্তিনি সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান হয়নি। বরং আরব এলাকায় ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতি অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর (১৯৪৮) একাধিকবার ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের খবর আমরা জানি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল সিনাই, পশ্চিমতীর, গাজা ও গোলান উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিনিময়ে (মিসর-ইসরায়েল পরস্পর স্বীকৃতি) মিসর তার হারানো সিনাই উপত্যকা ফিরে পেলেও সিরিয়া আজও গোলান উপত্যকা ফিরে পায়নি। গোলানে তেল পাওয়া গেছে এবং পানির বড় উৎস রয়েছে এখানে। ফলে ইসরায়েল গোলান উপত্যকার কর্তৃত্ব ছাড়বে না। গোলান এখন ইসরায়েলের অংশ।
ইসরায়েল রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের একটি বাস্তবতা। একসময় পিএলও ইসরায়েল রাষ্ট্র ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল। তারা সত্তরের দশকে একাধিক যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে তা উড়িয়ে দিয়েছিল। বিখ্যাত লায়লা খালেদের কথা এখনো অনেকে স্মরণ করতে পারেন। একটি প্লেন হাইজ্যাক করে (টিডব্লিউ ফ্লাইট ৮৪০, ১৯৬৯) তিনি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছিলেন। প্লেন হাইজ্যাকিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। কিন্তু একসময় সেই পিএলওই উপলব্ধি করেছিল সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে শান্তি আসবে না। তাই ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স সম্মেলনে পিএলও সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করেছিল। এর পর পরই ইসরায়েল ও পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয় (১৯৯৩) ও একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিল। তবে নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ, যার পেছনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি বড় কর্তৃত্ব রয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ডেকে আনবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে ফিলিস্তিন সম্পর্কে ট্রাম্পের ফর্মুলার একটা যোগসূত্র আছে। চলতি বছর ফিলিস্তিন সংকটের ব্যাপারে ট্রাম্প একটি ফর্মুলা উত্থাপন করেন। তার প্রস্তাবে রয়েছে- ১. জেরুজালেমের একটা বড় অংশ থাকবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে এবং জেরুজালেম হবে ইসরায়েলের রাজধানী; ২. ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা আর ফিরে আসতে পারবে না; ৩. ইসরায়েল ও ওয়েস্ট ব্যাংকের মধ্যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ; ৪. ফিলিস্তিনিরা কোনো নিরাপত্তারক্ষী বা ফোর্স গঠন করতে পারবে না। স্পষ্টতই এই ফর্মুলা ফিলিস্তিনিরা সমর্থন করেনি। অভিযোগ আছে, ইসরায়েলের স্বার্থেই তিনি এই ফর্মুলা উপস্থাপন করেছেন। লন্ডনের গার্ডিয়ানে রশিদ খালিদি লিখেছেন, ওই ফর্মুলা সংকট আরও বাড়াবে (৩০ জানুয়ারি ২০২০)।
যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংকট সমাধানে একটি ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু ট্রাম্প ফর্মুলা একপেশে হওয়ায় আপাতত এই সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। দীর্ঘ ৭৩ বছরেও একটি সমস্যার সমাধান না হওয়া একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতির জন্যও একটি খারাপ সংবাদ। কিন্তু তার পরও তার সাফল্য এক জায়গায় আর তা হচ্ছে, আরব আমিরাত ও বাহরাইনকে ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত করা। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিদের খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। তাদের হতাশা আরও বাড়ল। তারা এই চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বর্ণনা করেছে। আরবরা এতদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পক্ষেই কথা বলে আসছে। এখন তাতে ছেদ পড়ল। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেম আর পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের মধ্যে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন আরও অনিশ্চয়তায় ভরে গেল। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইসরায়েলের জন্য এই চুক্তি (আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের) একটা প্লাস পয়েন্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প ইহুদি লবির সমর্থন আরও নিশ্চিত করলেন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এটা কাটিয়ে তিনি রাজনৈতিভাবে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল তার দুর্বল অবস্থানও শক্তিশালী করতে পারবে। ইরান খোদ ইসরায়েল এবং একই সঙ্গে আরব আমিরাত ও বাহরাইনের জন্যও হুমকি। এখন এই চুক্তির মধ্য দিয়ে এই আরব দেশ দুটি তাদের নিরাপত্তাহীনতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আগামীতে ইসরায়েল যদি কোনো সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, আমি অবাক হব না। ইরানকে নিয়ে শঙ্কা সৌদি আরবেরও। ফলে নতুন এক ‘সামরিক ম্যাপ’ তৈরি হবে এ অঞ্চলে। আরব বিশ্বে বড় ধরনের সামরিক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সহযোগিতা নিয়ে আরব আমিরাত অন্যতম সামরিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে এ অঞ্চলে। আরব আমিরাত ইতোমধ্যে লিবিয়া ও ইয়েমেনে তাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তার সামরিক শক্তিকে জানান দিয়েছে। ইরানকে নিয়ে তাদের ভয় এখন দূর হবে। বাহরাইনের অবস্থানও তেমনি। তাদেরও ভয় ইরানকে নিয়ে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ইরান দাবি করত বাহরাইন তাদের দেশেরই অংশ। এ দেশটির শাসকরা সুন্নি, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। বাহরাইনের শাসক হামিদ বিন ইসরা আল খালিফা বরাবরই একটা শিয়া অভ্যুত্থানের ব্যাপারে শঙ্কিত। এই চুক্তি বাহরাইনের শাসকদের ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে। কিন্তু মূল প্রশ্ন এক জায়াগাতেই- ফিলিস্তিন সংকটের কোনো সমাধান এতে হবে না এবং মধ্যপ্রাচ্য একটি বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্যে পড়ল।
Amader Somoy
19.9.2020
এই লিখাটা পড়া যাচ্ছে না
ReplyDelete