রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ও আমাদের শঙ্কার জায়গা

  

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি শব্দ ব্যাপকভাবে সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে; আর তা হচ্ছে- ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ তথা Vaccine Nationalism। এর অর্থ কী? কিংবা অনুন্নত বিশ্বের জন্য এটা কোনো তাৎপর্য বহন করে কি না? এটা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভ্যাকসিন বা টিকা ছাড়া কোভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না (যেমনটি হয়েছিল ‘স্মল পক্সের’ ক্ষেত্রে), তখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এলো টিকা গবেষণায় ও উৎপাদনে।

২০২০ সালের মধ্যে এ টিকার সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এরইমধ্যে ধনী দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র) বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কোভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার আগেই তাদের দেশের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ, টিকাটি তারা আগে নিতে চায়। যেখানে বিশ্ব সংস্থা, GAVI-the Vaccine Alliance, Coalition for Epidemic Preparedness Innovations (CEPI) দ্রুত টিকাটি বিশ্বের সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় (নিঃসন্দেহে যা সময় সাপেক্ষ), সেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকাটি আগে নিতে চায়। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’।

বিশ্বের জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৭৮০ কোটি। একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। ফলে টিকাটি সবার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে টিকা বাজারে আসবে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত AstraZeneca-র টিকাটি নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যাদের ওপর এ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোম্পানি তৃতীয় ট্রায়াল স্থগিত রেখে আবার তা শুরু করেছে। ফলে যে কোম্পানিগুলো কোভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ইতোমধ্যে সফলভাবে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে (চীন ও রাশিয়ার কোম্পানি), তাদের টিকা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফাইজারের টিকা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে।

এখন বড় দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না-এই যে বৈষম্য, এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ‘হু’র মহাসচিব টেড্রস আধানম গেব্রিয়েসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিরোধ করতে হবে। COVAX ইতোমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে-সে প্রশ্ন আছেই।

ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, AstraZeneca-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার-তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, করোনাভাইরাসও ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে ইতিহাস বলে, ২০০৯ সালে যখন মহামারী H1N1 ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকা রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো যেমন: যুক্তরাষ্ট্র ৬ লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কোভিড-১৯ টিকার ক্ষেত্রেও এমনটি হল। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (৬টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে Airfinity-র মতে, ২০২২ সালের প্রথমভাগের আগে কোনোমতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এ পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয়, টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হবে। উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে সরবরাহ করতে বাধ্য। তাহলে আমরা পাব কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ভরসা আমাদের চীনা ও রুশ কোম্পানি। তাদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ ‘My Nation First’-এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ আমার দেশ আগে পাবে- এ ধারণা নিয়ে এগিয়ে আছে ধনী দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা। কিন্তু ‘My Nation First’ ধারণার কারণে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলোর স্বার্থ। Harvard Business Review-র এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে: If countries with a large number of cases lag in obtaining the vaccine and other medicines, the disease will continue to disrupt global supply chains and, as a result, economies around the world. (Rebecca Weintraub, Asaf Bitton and Mark L. Rosenberg-এর প্রবন্ধ The Danger of Vaccine Nationalism, May 22, 2020)।

কোভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারী। এ ক্ষেত্রে একটা বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল কিছু দেশ ‘এককভাবে’ চলতে চেষ্টা করছে এবং সম্মিলিতভাবে কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল গ্রহণ করেনি। কয়েকটি তথ্য দেয়া যেতে পার। ইউরোপের দেশগুলো, বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও Wellcome Trust ৮০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT) অর্থাৎ কোভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবেলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হবে। এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ফ্রান্সের কোম্পানি সানোফির সিইও পল হাডসন মনে করেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ও টিকা সরবরাহের ব্যাপারে একটি প্রি-অর্ডার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু তাদের টিকা পাওয়ার অধিকারটি বেশি। ভারতের Serum Institute, যারা টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আছে, সেই সংস্থার প্রধান বলেছেন, Serum যা উৎপাদন করবে, তা প্রথমে পাবে ভারতের জনগণ। এরপর তা বহির্বিশ্বের মানুষ পাবে। AstraZeneca, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদন করছে, তাদের উৎপাদিত টিকা প্রথমে পাবে ব্রিটেনের মানুষ (প্রায় ৩ কোটি ডোজ)। কারণ, যুক্তরাজ্য সরকার টিকা উৎপাদনে ৭৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখানে বিনিয়োগ করে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত টিকার মধ্যে ৩০ কোটি ডোজ পাবে। ট্রাম্প প্রশাসন Operation Warp Speed অর্থাৎ দ্রুত মানুষকে টিকা দেয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার আওতায়ই এ টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এর অর্থ হচ্ছে, ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে এবং তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এ জন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ আগেভাগে নিশ্চিত করেছে। এখানে মানবতা প্রাধান্য পায়নি। এমনকি ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’- নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 বা Swine Flu-র সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গেছে ২ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল, শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ বেশি তারাই H1N1-এর টিকা পেল আগে। দ্রুত যে দেশগুলো সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে টিকা পায়নি। ভাইরাস কখনও ধনী ও গরিব দেশ দেখে ছড়ায় না। ভারতে দারিদ্র্য বেশি। অথচ দেশটি কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশগুলোর তালিকায় আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। মৃত্যুর দিক থেকে ব্রাজিলকেও ছাড়িয়ে গেছে ভারত। এ জন্যই গবেষক, ভাইরোলজিস্টরা এমন একটা মডেলের তথা ব্যবস্থার কথা বলছেন, যেখানে ধনী দেশগুলোর তথাকথিত ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ প্রাধান্য পাবে না, টিকাটি সার্বজনীন হবে এবং গরিব দেশগুলো টিকাপ্রাপ্তির তালিকায় অগ্রাধিকার পাবে। ভাইরাসের সঙ্গে যেহেতু টিকা বা ভ্যাকসিনের প্রশ্নটি জড়িত এবং বিশ্বকে মহামারীমুক্ত রাখতে হলে ভ্যাকসিন ছাড়া বিকল্প নেই, সেহেতু বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল Bill and Melinda Gates Foundation, Global Fund, CEPI, কিংবা GAVI-র মতো সংস্থা, যারা গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় টিকা সরবরাহে ‘কমিটেড’। বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ভারতে শিশুদের প্রাণঘাতী মহামারী থেকে বাঁচাতে একটি বড় কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল এবং তাতে সফলও হয়েছে।

সুতরাং ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’, যা কোভিড-১৯-কে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে, বিশ্ব থেকে মহামারীটি নির্মূল করার জন্য সহায়ক নয়। বিশ্ব বারবার মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে এবং বিজ্ঞান এ ধরনের মহামারী নির্মূল করতে সমর্থ হয়েছে। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় ছাড়া কোভিড-১৯ টিকা বাজারে আসছে না। চীন ও রাশিয়ার টিকা বাজারে আসার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু চীনা টিকা কতটুকু কার্যকর কিংবা রাশিয়ার টিকার (স্পুটনিক-ভি) তৃতীয় ট্রায়াল আদৌ সম্পন্ন হয়েছে কি না-এসব নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ বা My Nation First কর্মসূচি উন্নয়নশীল বিশ্বের শতকোটি মানুষকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিতে পারে। আমাদের শঙ্কাটা এখানেই।

Jugantor

20.9.2020

0 comments:

Post a Comment