গেল সপ্তাহে মস্কোতে ভারত ও চীনের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হিমালয় অঞ্চলে ভারত-চীন সীমান্তে আবার উত্তেজনা বাড়ছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বরের খবর বিতর্কিত ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের’ (এলএসি) কাছে চীন বেশ কিছু এইচ-৬ বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে। এ খবরটি দিয়েছে মিলিটারি ওয়াচ ম্যাগাজিন। এইচ-৬ বোমারু বিমান ও বিভিন্ন ধরনের ক্রুজ মিসাইলএসব চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিকে লাদাখ অঞ্চলে ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের সংঘাতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেবে।
ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, নতুন সিজে-২০ ক্রুজ মিসাইলগুলো ৫০০ কেজি পর্যন্ত ওয়ার হেড বহন করতে পারে এবং এগুলো ২০০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে আঘাত হানতে পারে। এর আগে ৩১ আগস্টের এক খবরে বলা হয়েছিল, ডোকলাম ও সিকিমের স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকায় দুটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করছে চীন। উপগ্রহ চিত্রে তা ধরা পড়েছে। দুটো ঘাঁটিই ডোকলাম গিরিপথ থেকে ৫০ কিমি আওতার মধ্যে এবং ডোকলাম মালভূমির কাছে। বলা ভালো, ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সংঘর্ষ ও ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর গত ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন। যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে তারা একমত হয়েছেন, তা হচ্ছে সীমান্তে সেনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সব চুক্তি ও প্রটোকল মেনে চলা।এদিকে আনন্দবাজার আমাদের জানাচ্ছে, ২৯-৩০ আগস্ট রাত থেকে শুরু করে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় অন্তত চারটি চীনা আগ্রাসনের ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় প্যাংগং এলাকায় ৪৫ বছরের রীতি ভঙ্গ করে একটি ঘটনায় ১০০ থেকে ২০০ রাউন্ড সতর্কতামূলক গুলি চলেছে (আনন্দবাজার, ১৬ সেপ্টেম্বর)। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলেছে, সেখানে দুই পক্ষের সেনার দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটারের মতো।
এখন সীমান্ত উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ভারত-চীন সমঝোতা মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ ভারত-চীন সমঝোতা করোনা-পরবর্তী নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একসময় Chindea-এর ধারণা এভাবেই বিকশিত হয়েছিল। ভারতের রাজনীতিবিদ (কংগ্রেস) ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশও Chindea-এর ধারণা প্রোমোট করেছেন (ইকোনমিক টাইমস, ২৭ মার্চ, ২০১৪)। সমসাময়িককালের একজন বহুল আলোচিত জিও-স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট ডি. কাপলানও তার লেখনীতে (বিখ্যাত গ্রন্থ Monsoon) সম্ভাব্য চীন-ভারত আঁতাতের কথা উল্লেখ করেছিলেন। চীন ও ভারত যদি এক মঞ্চে কাজ করতে পারে, তাহলে বদলে দিতে পারে বিশ^কে। ভারত ও চীনের মোট এলাকার পরিমাণ ১,২৯,২৮,০৬১ বর্গকিলোমিটার। বিশে^র মোট জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের এক ভাগ (২৭২ কোটি) এই দুই দেশে বসবাস করে। দুটো দেশের জিডিপির পরিমাণ (পিপিপি) ৩৫.৬২৪ ট্রিলিয়ন ডলার (সাধারণ নিয়মে ১৬.১৫ ট্রিলিয়ন ডলার)। অর্থনীতিতে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২০১৬ সালের বিশে^ চীনের অবস্থান ছিল এক নম্বরে (সাধারণ হিসেবে দুই নম্বরে)। ২০৫০ সালে জিডিপির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তাতেও চীন থাকবে এক নম্বরে (পিপিপি)। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল দুই নম্বরে (পিপিপি, ২০১৬), তা নেমে আসবে (২০৫০) এ নম্বরে। আর ভারত অবস্থান করবে দুই নম্বরে। ফলে চীন ও ভারত যদি একত্র হয়, তাহলে বদলে দেবে বিশ্বকে।চীনকে এখন বলা হয় ‘উৎপাদনের কারখানা’ অর্থাৎ সব পণ্যই চীন উৎপাদন করে ও সস্তায় তা বিশে^র সর্বত্র পৌঁছে দেয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও চীনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর মাধ্যমে চীন ৬১টি দেশকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে সার্ভিস সেক্টর ও ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ভারত বিশ্বের একটা অবস্থান তৈরি করেছে। দেশ দুটো বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ব্রিকসব্যাংক (২০১৪) প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশ দুটো সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সদস্য (২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। ফলে নয়া বিশ্বব্যবস্থা বিকাশে এই দেশ দুটি একত্র হয়ে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে গালওয়ানের ঘটনাবলি দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করল কি না সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
এখানে আমরা গালওয়ানের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারি। গালওয়ান নদী আকসাই চীন ও লাদাখকে আলাদা করেছে। লাদাখের আগে রয়েছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমাচল রাজ্য, পশ্চিমে রয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গিলগিট-বাল্টিস্তান আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে চীনের ঝিন ঝিয়াং (Xinjiang) প্রদেশ। সিয়াচেন হিমবাহ ও চীনের আকসাই চীন এ অঞ্চলের মধ্যেই অবস্থিত। এই লাদাখেই অবস্থিত কারগিল আর কারগিলে (১৯৯৯) ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের কথা অনেকেই স্মরণ করতে পারেন। লাদাখের গুরুত্ব এ কারণে যে, তিব্বত চীনের অধিভুক্ত হওয়ার (১৯৫০-৫১) পর সাম্প্রতিকালে সেখানে চীনবিরোধী অসন্তোষ বাড়ছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামা ভারতে আশ্রয় নেন এবং এখনো সেখানে আছেন। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধরমশালায় একটি তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের অস্তিত্বের খবরও আমরা জানি, যার প্রধান দালাইলামা স্বয়ং। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল, যেখানে তিব্বতি নেতাদের সঙ্গে চীনের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আর অতি সম্প্রতি গত মে মাসে কংগ্রেসম্যান স্কট পেরি মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল (৬৯৪৮) উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সংগতকারণেই লাদাখের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বাড়ছে।
তিব্বতের পাশাপাশি ঝিন ঝিয়াংয়ের অধিবাসী উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে চীনের একটি ‘সমস্যা’ রয়েছে। উইঘুরে চীন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এ ধরনের অভিযোগ তুলে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইনও পাস হয়েছে (Uyghur Human Rights Policy Act of 2020, Uyghur Human Rights Policy Act of 2019, S. 3744)। উইঘুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও এই আন্দোলনের পেছনে বাইরের শক্তির মদদের ব্যাপারে চীন অবগত। ফলে এই অঞ্চলের কোনো শক্তি চীনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে যাতে জড়িত হতে না পারে, চীন সে ব্যাপারে সতর্ক। সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে (১০০০ বর্গমাইল) ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের খবর (১৯৮৪) আমরা জানি। চীনের কাছেও এই হিমবাহের গুরুত্ব আছে। আকসাই চীনের একটি অংশ Shaksgam Valley একসময়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পাকিস্তান চীনকে হস্তান্তর করে। আর ভারতের হিমাচল রাজ্যটি যে চীনের এ দাবি থেকে চীন এখনো সরে আসেনি। গালওয়ান উপত্যকায় (১৪৭০০ বর্গমাইল) ভারতীয় কর্মকাণ্ডকে চীন তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছে। গালওয়ান উপত্যকার সীমানা চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত ‘লাইন অব কন্ট্রোল’-এর পাশাপাশি ভারত ২৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। এই সড়কটি লাদাখের রাজধানী লেহ-এর সঙ্গে চীনা সীমান্তের কাছাকাছি দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমানঘাঁটিতে সংযুক্ত করেছে। এটি একটি দুর্গম এলাকা। আগে লেহ থেকে দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমানঘাঁটিতে পৌঁছাতে দুদিন লাগত। এখন লাগে মাত্র ছয় ঘণ্টা। ভারতী সমরনায়কদের কাছে দৌলতবেগ আলভি বিমানঘাঁটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এখান থেকে চীননিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন, যা ভারত নিজর বলে দাবি করে, এর সীমান্ত মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর সিচিয়ান গ্লেসিয়ারের দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। এই বিমানঘাঁটিতে ভরত অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। চীন কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যেকোনো যুদ্ধে এই বিমানঘাঁটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পুরো এই এলাকাটি মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। বর্তমানে যেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা পশ্চিম অংশ হিসেবে বিবেচিত। লাদাখ ও আকসাই চীন এর অন্তর্ভুক্ত। মধ্যম অংশে অন্তর্ভুক্ত হিমাচল, উত্তরখণ্ড রাজ্য ও তিব্বতের দক্ষিণ অংশের একটি অংশ। আর পূর্ব অংশের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ তিব্বত ও পূর্ব ভারত। পুরো এই তিনটি অংশেই অতীতে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত বহুল আলোচিত যুদ্ধ হয়েছিল লাদাখ ও আকসাই চীনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৬৭ সালে সংঘর্ষ হয়েছিল সিকিমের নাথু লা ও চো লা গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৭৫ সালেও এখানে দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। আর ২০১৭ সালে ডোকলামে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। ডোকলামে যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক চীনের জন্মের মাত্র ছয় বছরের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে থাকা নন-কমিউনিস্ট দেশ ও সরকারপ্রধান হিসেবে যিনি প্রথম পেইচিং সফরে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু। বিখ্যাত ও আলোচিত মাও সে তুংয়ের সঙ্গে নেহরুর ছবি এখনো অনেকের চোখে ভাসে। আজ থেকে ৬৬ বছর আগে ভারত ও চীন এভাবেই একটা বন্ধুত্বের সূচনা করেছিল। অনেকের কাছে ‘হিন্দি-চীন ভাই ভাই’ সেøাগানের কথা এখনো মনে আছে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি সম্পর্কে ওই সময় পশ্চিমা সমাজে এক ধরনের ভীতি ছিল এবং ১৯৪৮ সালের চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বে বড় ধরনের একটি ‘আতঙ্ক’ সৃষ্টি করেছিল (?), আর গণতান্ত্রিক ভারত, যে দেশটি পুুঁজিবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে থেকে তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়, পরস্পরবিরোধী এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কীভাবে সম্পর্ক হবে, এর ভিত্তি কী হবে, এটা নিয়ে শত প্রশ্ন ছিল। অনেক আপত্তি ছিল। সব আপত্তি উপেক্ষা করে নেহরু ছুটে গিয়েছিলেন চীনে। আর ওই সফরেই এই দুই নেতা, মাও সে তুং ও নেহরু জন্ম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চশীলা’ নীতির। এর আগে জুন মাসেই (১৯৫৪) দিল্লি সফর করে গিয়েছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। তখনই ‘পঞ্চশীলা’র প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল চীনের তরফ থেকে, যা নেহরুর পেইচিং সফরে স্থায়ী ভিত্তি পেয়েছিল। এই ‘পঞ্চশীলা’ নীতিকে কেন্দ্র করেই ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বাং দুং-এ সূচনা হয়েছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের। কিন্তু এই ‘হিন্দি-চীন’ সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে। প্রথমে ডোকলাম, পরে গালওয়ান সব মিলিয়ে হিমালয় অঞ্চল এখন উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা। উভয় রাষ্ট্রের জন্যই এই অঞ্চলের গুরুত্ব রয়েছে। এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থেই ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখা জরুরি।
Desh Rupantor
22.9.2020
0 comments:
Post a Comment