একটি ছবি, একটি সংবাদ, অনেক প্রশ্ন
06:41
No comments
গত ৬ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের (সমকাল) প্রথম পাতার একটি ছবি। একজন রোহিঙ্গা নারী পারভিন আক্তার ভাসানচর থেকে ভিডিওকলে টেকনাফে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার হাসিমাখা ছবি বলে দেয় ‘নতুন জীবনে’ তিনি খুশি। এক সময় মিয়ানমারের রাখাইনের স্থায়ী বাসিন্দা পারভিন ২০১৭ সালে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। ঠাঁই হয় কুতুপালং ক্যাম্পে। এখন তার নতুন জীবন ভাসানচরে। এ জীবন তার কতদিনের, তা তিনি জানেন না। তবে কুতুপালংয়ের ‘বস্তির জীবনের’ চেয়ে ভাসানচরের জীবন যে অনেক ভালো, তা তার হাসিমাখা মুখের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। এ ধরনের ছবি সংবাদপত্রে আর টিভিতে আরও আছে। প্রায় প্রতিদিনই ভাসানচরের ‘নতুন জীবনের’ ছবি ছাপা হচ্ছে, আর তা আমাদের জানান দিচ্ছে সেখানে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা UNHCR। তাদের অভিযোগ, ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া হয়নি (ভোয়া, ০৭ ডিসেম্বর, ২০২০)। এক বিবৃতিতে UNHCR বলেছে, ভাসানচরে যে কোনো পুনর্বাসন হওয়া উচিত প্রযুক্তিবিষয়ক সুরক্ষার অধীনে। ভাসানচরে ‘শরণার্থীদের’ বসবাসের নিরাপত্তা, উপযোগিতা ও তা টেকসই কিনা, সেটা নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চায় জাতিসংঘ। একই সঙ্গে সুরক্ষা কাঠামো, সহযোগিতা এবং মূল ভূখণ্ডে ফেরার উপযোগিতা যাচাই করে দেখতে চায় তারা (মানবজমিন, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২০)। তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাও বলতে চায়- একথাও এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন UNHCR-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। কিছু আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিরোধিতা করছে। একদিকে বাংলাদেশের উদ্যোগ, অন্যদিকে জাতিসংঘের বিরোধিতা কতগুলো প্রশ্নকে এখন সামনে নিয়ে এলো। এক. এ স্থানান্তর যৌক্তি কিনা? এটি যৌক্তিক। কারণ কক্সবাজারে ক্যাম্পে যেভাবে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছিল, তা ছিল অমানবিক। ছোট ছোট খুপরি ঘরে তারা থাকতে বাধ্য হতো। সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ছিল। উপরন্তু সেখানে নিত্যদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বড় কথা, বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে একাধিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণকে বিতাড়িত করে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এদের উপস্থিতি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪ হাজার ৩০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। ৩ থেকে ৪ হাজার একর পাহাড়ি এলাকা নষ্ট করে সেখানে ক্যাম্প বানানো হয়েছে। টেকনাফ, উখিয়া, হিমচর এলাকায় পুরো বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা যদি আরও কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ এলাকায় কোনো গাছগাছালি থাকবে না। কারণ প্রতি মাসে ৬ হাজার ৮০০ টন কাঠ রোহিঙ্গারা ব্যবহার করে রান্নার কাজে। গাছ কেটে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাছে জ্বালানির কোনো বিকল্প উৎসও নেই। ইতোমধ্যে এটি প্রমাণিত যে, বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে কক্সবাজারে পুরো পাহাড় কেটে ফেলা, বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পরিবেশের যে ক্ষতি করে ফেলেছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিম্নাঞ্চলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে, হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সারা বিশ্ব আজ যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেখানে কক্সবাজার এলাকায় হাজার হাজার বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গারা বড় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ জাতিসংঘ যখন ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে, তখন বাংলাদেশের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি জাতিসংঘ বিবেচনায় নেয়নি।
রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরও ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করতে পারে কিনা? বিদেশি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সে পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশ পায়নি। ফলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যয় বাংলাদেশ সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এ ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। যে পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হয়, সে অর্থ অন্যত্র উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে ব্যয় করা যায়। বন্যা মোকাবেলায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা যায়। কোভিড-১৯-পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন, ভাইরাস নির্ণয় সংক্রান্ত গবেষণার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি কাজে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না।
জাতিসংঘ এক ধরনের আপত্তি করেছে বটে; কিন্তু আজ অবধি মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি তাদের নাগরিকদের ফেরত দিতে। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তির স্বার্থ দেখছে। বৃহৎ শক্তি যা চায়, জাতিসংঘ তা-ই করে। বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করা লাখ লাখ রোহিঙ্গার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিতে যে অর্থ প্রয়োজন, জাতিসংঘ তা সংগ্রহ করতে পারেনি। ইরানের প্রশ্নে জাতিসংঘ স্বার্থ দেখেছিল বৃহৎ শক্তির। অর্থনৈতিক অবরোধের পরিধি বাড়িয়ে বৃহৎ শক্তির স্বার্থই রক্ষা করেছিল জাতিসংঘ। অথচ মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রাথমিক রায়ও গেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরও জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই। সুতরাং আজ যখন রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ‘ঘাড়ে চেপে বসেছে’, তখন বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা তাদের স্বার্থে কাজ করে। রোহিঙ্গাদের নাম ভাঙিয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করে এবং এর ছোট একটা অংশ তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করে। কক্সবাজার এলাকায় গেলে দেখা যাবে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট হোটেল, রিসোর্টগুলো তাদের দখলে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের যদি বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রাখা যায়, লাভটা তাদেরই! অথচ যতদূর জেনেছি, সরকার ভাসানচরে আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, প্রয়োজনে সেখানে থেকে কর্মীরা যাতে রোহিঙ্গাদের দেখভাল করতে পারে। কিন্তু তারা সেটা চাইছে না। কক্সবাজারের পাঁচ তারকা হোটেলের বিলাসী জীবন ছেড়ে তারা ভাসানচরে থাকতে চায় না! সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। মাত্র ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা এক লাখের। সেখানে অনেক আগে থেকেই বসবাসের এক ধরনের ‘পরিবেশের’ জন্ম হয়েছে। ১০ হাজার মহিষ সেখানে চড়ে বেড়ায়। ভাসানচরের মোট এলাকা ১৩ হাজার একর। বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য জমি ৬ হাজার ৪২৭ একর। আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে উঠেছে মাত্র ১ হাজার ৭০২ একর এলাকায়। ফলে বিশাল এক এলাকা রয়ে গেছে অব্যবহৃত। ১ লাখ রোহিঙ্গার অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলা খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গারা কৃষিকাজ, গবাদি পশু লালন-পালন কাজে নিজেদের জড়িত করতে পারে। এতে করে তারা তাদের সময়টা সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারে। সেখানে রয়েছে উপযুক্ত বাঁধ, নিরাপত্তা, চিকিৎসাসেবা, দ্রুত যাতায়াতব্যবস্থা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, খাবার সংরক্ষণ ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। ফলে খুব দ্রুতই এ অঞ্চলটি যে আধুনিক একটি ছোট শহরে পরিণত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিছু প্রশ্ন তো আছেই। সরকার শুধু কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে তাদের দায়িত্ব ‘পালন’ করছে, এটা চিন্তা করলে ভুল হবে। অনেক কাজ এখনও বাকি। প্রথমত, রোহিঙ্গা ভাষায় শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, বাংলা ভাষায় নয়। মহিলাদের কুটির শিল্পের কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে, যাতে এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পুরুষদের কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে উৎসাহ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। সেখানে যাতে কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতার জন্ম না হয়, যাতে করে মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা এখানে প্রবেশ করে অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সে জন্য বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি সেখানে থাকতে হবে। পুরো দায়িত্বটি ছেড়ে দিতে হবে নৌবাহিনীর হাতে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের মাঝে সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। এরা যাতে ওই এলাকায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পরে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
তৃতীয়ত, পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশকে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে আরও ‘ভাসানচর’ তৈরি করতে হবে। ভাসানচরে খুব বেশি রোহিঙ্গা স্থানান্তর ঠিক হবে না। পরিত্যক্ত দ্বীপগুলোকে খুব শিগগিরই বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, ভাসানচরে স্থানান্তর রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নয়। জোর দিতে হবে কূটনীতির ওপর। এ কাজটি আমরা খুব সহজভাবে করছি বলে মনে হয় না। ওয়াশিংটন, ব্রাসেল্স আর জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর ‘অ্যাকটিভ ডিপ্লোম্যাসি’ আমার চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু কথা বলেন। কথা বলে জাতীয় স্বার্থ আদায় করা যায় না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বহিঃবিশ্বে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা প্রয়োজন। মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। মিয়ানমার চুক্তি করে এদের ফেরত নেয়ার কথা বললেও একজন রোহিঙ্গাকেও তারা ফেরত নেয়নি। আমাদের কূটনৈতিক অসফলতা এখানেই যে আমরা আমাদের মানবিক দিকটি সঠিকভাবে বিশ্বে তুলে ধরতে পারিনি। প্রতি বছর ক্যাম্পে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। একটি বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গড়ে উঠছে আমাদের বাসভূমে। এরা বিদেশি নাগরিক। এরা আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। ভাসানচরে এদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে স্থানান্তর করে আমরা কাজটি যেমন সঠিক করেছি, ঠিক তেমনি কূটনৈতিকভাবেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জায়গাটিতে আমাদের কিছু দুর্বলতা এখনও রয়ে গেছে।
Jugantor
13.11.2020
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment