রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনার টিকা নিয়ে নানা কথা

বিশ্বে কোভিড-১৯-এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ যখন আঘাত করেছে, তখন স্বস্তির জায়গা একটাই-যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রতিষেধক হিসেবে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে করোনার টিকা আবিষ্কার একটা বড় ধরনের অর্জন। কিন্তু এ টিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এটা নিয়ে আগামী দিনে বিতর্ক হতে পারে। বিশ্বব্যাপী যে বিতর্ক তা হচ্ছে, এ টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মাঝে নতুন এক বৈষম্য সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের আর্থিক সক্ষমতার জোরে আগেই এ টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। দ্বিতীয় বিতর্কটি হচ্ছে, এ টিকা কতটুকু নিরাপদ? ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতার শীর্ষে যে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা তাদের কার্যকারিতার হার প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির যৌথ উদ্যোগে ফাইজার ও বায়োএনটেক তাদের ভ্যাকসিনের ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতার ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক মডার্না জানিয়েছে, তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ৯৪.৫ শতাংশ। সুইডিশ ফার্ম অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ৯০ শতাংশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ভ্যাকসিনের ঝুঁকির কথাও আমাদের জানিয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন নেয়ায় এক ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে। তৃতীয়ত যে সমস্যা তা হচ্ছে এর সংরক্ষণ। ফাইজারের যে ভ্যাকসিন, তা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এ টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। বিশেষ করে আফ্রিকা ও উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ এ টিকা তাদের সংগ্রহে রাখতে পারবে না, যদিও মডার্নার ভ্যাকসিন নিয়ে এ ধরনের সমস্যা নেই। মডার্নার ভ্যাকসিন রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আবার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুটনিক-ভি, রাশিয়া) ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ৬ মাস পর্যন্ত রাখা যাবে বলে বলা হচ্ছে। চতুর্থত আরেকটি যে সমস্যা তা হচ্ছে, এ ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে পাবে, নাকি কিনতে হবে? এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোনো কোম্পানির ভ্যাকসিনই বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, ভ্যাকসিন কিনতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে-ভ্যাকসিন ক্রয় করতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, গরিব দেশগুলোর জনগণের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব হবে কি না? একটা দৃষ্টান্ত দিই। বাংলাদেশ ভারত থেকে ভ্যাকসিন আনছে। সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ ওষুধ কিনবে বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য যে ১ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের খরচ দাঁড়াবে ৬ ডলার ২৫ সেন্ট। তবে যে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় তা হল বাংলাদেশে এই ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে তার নাগরিকদের দেয়া হবে কিনা। যদিও একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট, বেক্সিমকো এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের কথা বলা হয়েছিল। ১৭ কোটি দেশের মানুষের জন্য ৩ কোটি ডোজ কিছুই নয়। প্রত্যেককে দুটি করে (২১ দিন পর দ্বিতীয়টি) ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর অর্থ প্রায় ৩৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আমাদের দরকার। আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে- তা হচ্ছে, জানুয়ারিতে যে ভ্যাকসিন আসবে, তা প্রথম পর্যায়ে কারা কারা পাবে? একটি তালিকা সংবাদপত্রে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায় নিম্নলিখিতভাবে এ ভ্যাকসিন বরাদ্দ করা হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেট : ২০ হাজার ডোজ, বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর অফিস ২০ হাজার, সচিবালয় ৫০ হাজার, অধিদফতর ৫০ হাজার, সেনা, নেভি ও এয়ারফোর্স ২০ হাজার, পুলিশ ১০ হাজার, বিভাগীয় কমিশনার ১০ হাজার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০ হাজার ইত্যাদি। সরকার অবশ্য প্রকাশ্যে এ ধরনের কোনো ঘোষণা দেয়নি। যে কোনো সরকারি নথি থেকে সংবাদটি ফাঁস হয়ে থাকতে পারে। এ সংবাদটি যদি সত্য হয়, তাহলে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে বড় ও ধনী দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না-এই যে বৈষম্য, এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানোম গেব্রিয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এ ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিরোধ করতে হবে। Covax ইতোমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কোভিড-১৯-এর টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার-তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে-করোনাভাইরাস ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে ২০০৯ সালে যখন মহামারী H1N1 ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকার রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ৬ লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কোভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হল। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা দিতে বাধ্য থাকবে কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে Airfinity’র মতে ২০২২ সালের প্রথমভাগের আগে কোনোমতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এ পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হতে পারে। উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে টিকা সরবরাহ করতে বাধ্য। দরিদ্র দেশগুলো বাদ থেকে যাচ্ছে। তাদের অর্থ নেই, প্রযুক্তি নেই। ফলে বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে এটা হবে অন্যতম আলোচিত বিষয়। বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন এবং ইউরোপের ওয়েলকাম ট্রাস্ট ৮০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT) অর্থাৎ কোভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবেলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। তবে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ভ্যাকসিন একটি বড় পার্থক্য তৈরি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে-ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ নিশ্চিত করেছে। এখানে মানবতা প্রধান্য পায়নি। এমনকি ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’- নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 বা Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল, শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেয়েছে আগে, যে দেশগুলোয় রোগটি দ্রুত সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে স্থান পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এ দুর্ভাবনা এখনও শেষ হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনার টিকা আসবে; কিন্তু এ টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মাঝেই পার্থক্য সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। করোনার টিকা একটি বাস্তবতা। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় করোনার টিকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এ টিকা বাজারে আসার আগেই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল এক ধরনের বৈষম্য- যেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব রাষ্ট্রগুলো আরও গরিব হয়েছে। আর একুশ শতকের বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে আরেক রকম বৈষম্য। করোনাভাইরাস ‘মাই নেশন ফার্স্ট’ ধারণার জন্ম দিয়ে এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছে, যেখানে ভ্যাকসিনের প্রাপ্তির প্রশ্নে জন্ম হতে যাচ্ছে এক ধরনের বৈষম্যের। jugsntor 20.12.2020

0 comments:

Post a Comment