মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
21:30
No comments
মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও শীর্ষ নেত্রী অং সান সু চি ও সে দেশের প্রেসিডেন্ট উইন মিনতকে গ্রেপ্তারের পর মিয়ানমারের রাজনীতি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ঘটল এমন একটা সময় যখন ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর ওইদিনই, অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি (২০২১) পার্লামেন্ট অধিবেশন বসার কথা। নির্বাচনে অং সান সু চি’র দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে সংসদের উভয় কক্ষে বিজয়ী হয়েছিল। তার দল ‘লিগ ফর ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি’র নেতৃত্বে যখন আবারও সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই এই সেনা অভ্যুত্থান ঘটল।
সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সর্বশেষ ত্রিদেশীয় ভার্চুয়াল মিটিংয়ে (বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন) একটি সময়সীমাও যখন নির্ধারিত হয়েছিল, ঠিক তখনই এই সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা এ প্রশ্নকে সামনে আনল যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ এখন কী?
সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে যে যুক্তিটি দাঁড় করানো হয়েছে, তা হচ্ছে নভেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এর পরপরই সেনা অভ্যুত্থান ঘটল। যদিও অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে এই কারণটি মূল নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ংয়ের উচ্চাভিলাষ, জুলাই মাসে তার অবসরের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তির আশ্বাস না পাওয়া এবং সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত (সাংবিধানিকভাবে) তিনটি কেবিনেট পদে তার মনোনীতদের ব্যাপারে সু চি’র আপত্তিই মূল কারণ। গেল ৫ বছরে সেনাপ্রধানের সঙ্গে সু চি’র সম্পর্ক ‘ভালো’ থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছিল। গেল নভেম্বরে একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে, কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
এই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি।
গত বেশ কয়েক বছর যাবত সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চি’র একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছিল। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ফলে অং সান সু চি’র দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসবেন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। সবাই এটা জানতেন। সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থে সু চিকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। এখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারাও এ সমস্যার সমাধান করবে না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বেরও কোনো সমাধান দিতে পারবে না সেনাবাহিনী। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশ বাইরে রেখে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসত না। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ^ব্যাপী একসময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি এখন গণতান্ত্রিক বিশে^ একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। তার শাসনামলেই তিনি জাতিগত দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছিলেন। শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থেই যে তিনি কাজ করেছেন তেমনটি নয়, বরং সংখ্যাগুরু ‘বামার’দের তথা উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে যান। মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে এই বিষয়টিকে তিনি কখনই গুরুত্ব দেননি। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক হাম্মাহ বেক যখন লেখেন, ‘Her strongest critics accuse her, as a member of the Bamar ethnic majority, of racism and an unwillingness to fight for the human right of all people in Myanmar’, তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। নিজ ক্ষমতার স্বার্থে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা। এ জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হলেও তিনি নিজে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে যাচ্ছেন বারবার। উগ্র বৌদ্ধরা (পাঠক বার্মিজ বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত ভিথারুর কথা স্মরণ করতে পারেন) তাকে শুধু সমর্থনই করছে না, বরং রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগকেও সমর্থন করছে। হাম্মাহ বেক তার প্রতিবেদনে কাচিন প্রদেশের একজন রাজনীতিবিদ সেং নু পান (Seng Nu Pan)-এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, ‘Now that she has tasted Power, don’t think she wants to share it with anyone’ (তার প্রতিবেদন How a Human Right Angel Lost her Halo, Nov 14, 2020)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। সু চি কাউকে ক্ষমতার ভাগ দিতে চান না। যেখানে জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি, সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানে কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। তার এই ভূমিকা গণতান্ত্রিক বিশে^ নিন্দিত হয়েছিল। তার অনেক খেতাব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবিও করা হয়েছিল। এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হলো না। যে সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি ‘দি হেগে’ পর্যন্ত গিয়েছিলেন, সেই সেনাবাহিনীই তাকে উৎখাত করল।
তাহলে পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাচ্ছে? এক বছরের জন্য সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সওকে (Myint Swe) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মিন্ট সও একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হয়ে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হলেন। এর অর্থ হচ্ছে সেনাবাহিনী সর্বত্র কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। আর সেনাপ্রধান জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ংকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটা ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশনা পাওয়া যায়। জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ং হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তিনি একটি দল গঠন করতে পারেন, অথবা সেনা সমর্থিত দল ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’র নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেন। নভেম্বরের (২০২০) নির্বাচনে এই দলটি খুব ভালো করেনি। ‘হাউজ অব ন্যাশনালিটিস’-এ ২২৪ আসনের মধ্যে দলটি পেয়েছিল ৭ আসন। এনএলডি পেয়েছিল ১৩৮। সেনাবাহিনীর জন্য মনোনীত ছিল ৫৬টি আসন। আর ‘হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ’ এ দলটির আসন ছিল ৪৪০ আসনের মধ্যে ২৬ (এনএলডির ২৫৮, সেনাবাহিনী মনোনীত ১১০)। ফলে নির্বাচনী ফলাফলের ব্যাপারে দলটির অভিযোগ ছিল। এখন জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ং তার ক্ষমতায় থাকার জন্য এই দলটিকে ব্যবহার করতে পারেন। জুলাই মাসে (২০২১) তিনি অবসরে যাবেন। এরপর পূর্ণ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০২২ সালে তিনি নির্বাচন দিতে পারেন। ইতিমধ্যে সেনা সমর্থন নিয়ে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে অং সান সু চি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ। এখন এনএলডি বা ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার উদ্যোগ নিতে পারেন জেনারেল হল্লাইয়ং। কেননা একমাত্র অং সান সু চি-ই তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখেন। সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে তিনি কর্মীদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো গণ-অসন্তোষ সেখানে গড়ে উঠবে বলে মনে হয় না।
এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে মনে হয় না। এ বছরের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে মিয়ানমার রাজি হলেও, এই প্রক্রিয়া এখন ঝুলে যেতে পারে। সেনাবাহিনীর পেছনে সমর্থন রয়েছে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর। সেনাবাহিনীও তাদের ব্যবহার করে। আর এই বৌদ্ধ সংগঠনগুলো মুসলমান তথা রোহিঙ্গাবিরোধী। ফলে সেনাবাহিনী এদের বিরুদ্ধে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হবে না। তারা সময় ক্ষেপণ করবে।
মোট কথা মিয়ানমার আবারও পুরনো বৃত্তে ফিরে গেল। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী দেশটি শাসন করেছে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। ১৯৮১ সালে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন জেনারেল উ সান ইউ। নে উইন ক্ষমতা গ্রহণ করে গঠন করেছিলেন বার্মিজ সোশ্যালিস্ট পার্টি। উ সান ইউ দায়িত্ব নিলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা পরিচালনা করতেন নে উইন। ১৯৮৮ সালে বড় ধরনের ছাত্র বিক্ষোভে জেনারেল উ সান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নতুন প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল সেন লেন। কিন্তু ছাত্র বিক্ষোভের মুখে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর একজন সিভিলিয়ান মং সং ক্ষমতা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিলেও তাতে কাজ হয়নি। আরেক জেনারেল সু মং (সেপ্টেম্বর ১৯৮৮) ক্ষমতা নেন। একই পথে ১৯৯২ সালের মে মাসে আরেক জেনারেল থান শিউ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন। মাঝখানে ১৯৯১ সালে একটি নির্বাচন হয়েছিল ও তাতে এনএলডি বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেছিল। ১৯৮৯ সালে অং সান সু চিকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে তিনি অন্তরীণ অবস্থা থেকে ‘মুক্তি’ পেলেও নজরদারিতে ছিলেন। জেনারেল থান সিউ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গঠন করেছিলেন ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ (এসপিডিসি)। তিনি ছিলেন এর চেয়ারম্যান। তার খুব বিশ^স্ত ছিলেন জেনারেল খিন নাইয়ান্ট, যিনি মূল ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। ২০০৪ সালে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল সো উইন। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী একটি সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে শতকরা ২৫ ভাগ সিট রিজার্ভ রাখা হয়। ২০১০ সালে সেখানে নির্বাচন হয় এবং সেনা সমর্থিত ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’কে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় (এনএলডি নির্বাচনে অংশ নেয়নি)। ইতিমধ্যে সেখানে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল থাইন সেইন। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং তাতে এনএলডি বিজয়ী হয়েছিল।
ফলে এটা স্পষ্ট জেনারেল আউং হল্লাইয়ং দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসছেন। ফলে খুব সহসাই মিয়ানমার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Desh Ripantor
6.2.2021
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment