নেপালে সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হল গতকাল ৭ ডিসেম্বর। ২৬
নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচনের প্রথম ধাপ। ২০১৭ সালটা ছিল নেপালে
নির্বাচনের বছর। প্রথমে নেপাল সংবিধান সভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এরপর
সংবিধানের শর্ত অনুযায়ী গত মে মাসে সব স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন
হয়েছে। আর এখন সম্পন্ন হল সংসদ নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচন নেপালে
স্থিতিশীলতা কতটুকু নিশ্চিত করবে? সাম্প্রতিককালে নেপালে বারবার সরকার
পরিবর্তনের ফলে সেখানে বিকাশমান গণতন্ত্র একদিকে ঝুঁকির মুখে ছিল, অন্যদিকে
সৃষ্টি হয়েছিল অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা। তাই সঙ্গত কারণেই এ নির্বাচনের
দিকে দৃষ্টি ছিল অনেকের।
নেপালের এ নির্বাচন কোন দলকে ক্ষমতায় বসাবে, তা বলা সত্যিকার অর্থেই কঠিন।
গত ১০ বছরে সেখানে বারবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। কখনও মাওবাদীদের নেতৃত্বে
সরকার গঠিত হয়েছে, কখনোবা কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হয়েছে। মূলত তিনটি দলই মূল
ক্ষমতা পরিচালনা করছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলো। সম্প্রতি
বাম জোট গঠিত হয়েছে। এ জোটে আছে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও
মাওবাদীরা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউএমএল প্রথম ও মাওবাদীরা তৃতীয় স্থানে
ছিল। আর দ্বিতীয় স্থানে ছিল নেপালি কংগ্রেস, যার নেতৃত্বে রয়েছেন শের
বাহাদুর দেউশ, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীও বটে। এবার
নেপালি কংগ্রেস কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে ঐক্য করেছে। তারা যে জোটটি করেছে,
তার নাম গণতান্ত্রিক জোট। এখানে বলা ভালো, ২০১৫ সালে নেপালে নতুন যে
সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেই সংবিধানের আওতাতেই এবার নির্বাচনটি
অনুষ্ঠিত হয়েছে। নেপালি পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট : হাউস অব
রিপ্রেজেনটেটিভ (প্রতিনিধিসভা) ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (রাষ্ট্রীয়সভা)।
প্রতিনিধিসভার সদস্য সংখ্যা ২৭৫, যাদের একটা অংশ জনগণের ভোটে সরাসরি
নির্বাচিত হয়। আর রাষ্ট্রীয়সভার সদস্য হচ্ছে ৫৯। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের
২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৬৫ জন সরাসরি নির্বাচিত হন। জনসংখ্যা হিসাবে ১৬৫টি
এলাকা (সংসদীয়) নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন
আনুপাতিক হারে। প্রতিটি দল নির্বাচনে শতকরা যতভাগ ভোট পাবে, তাদের আনুপাতিক
প্রতিনিধিরা সেভাবে নির্ধারিত হবে। এভাবেই ১১০ জন ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর
হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে মোট ২৭৫ জন প্রতিনিধিত্ব করবেন। তারা ৫ বছরের জন্য
নির্বাচিত হবেন।
নেপালে একসময় রাজতন্ত্র ছিল। দীর্ঘদিন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলেছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নেপালে রাজতন্ত্রের পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ গণঅভ্যুত্থানে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ২০০১ সালের ১ জুন, তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু তিনি কখনই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। সরকার মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ এ অভিযোগ তুলে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা জ্ঞানেন্দ্র নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি। ফলে প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে তিনি তৎকালীন সাতদলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেপালে রাজতন্ত্র বাতিল ঘোষিত হয়। বলা ভালো, ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষিত হলেও সেখানে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় সরকারের স্থিতিশীলতা। গত ১০ বছরে সেখানে কয়েকটি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও প্রবল। একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা নিয়েও সমস্যা ছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে নেপালের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল চীনাপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীদের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা পরিত্যাগ করা এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। মাওবাদীরা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সাতদলীয় জোটের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সঙ্গে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল প্রচন্ড একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ চুক্তি বলে মাওবাদীরা মূলধারায় ফিরে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রচন্ড দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছিল সংবিধান প্রণয়ন করতে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেপালি রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। ১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে দীর্ঘ ৩২ বছর পর নেপালে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল, ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে সেই পার্লামেন্ট ভেঙে যায় মূলত নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। নেপালি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল মূলত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে। একদিকে ছিলেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, অন্যদিকে কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই। এ দ্বন্দ্বের কারণে শের বাহাদুর দেউবা এর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পার্টি ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কৈরালা ও ভট্টরাই কেউই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে দেউবা উঠে আসেন। দ্বন্দ্ব ছিল মাওবাদীদের মধ্যেও। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে মাওবাদীরাও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাই দু’জনেই সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী
হয়েছিলেন। মাওবাদীদের বাইরে ইউনাইটেড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টিও (ইউএমএল) নেপালের অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর পাশাপাশি মাদেসি ফ্রন্টও স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী।
এখন মূলত চার ব্যক্তিকে ঘিরে নেপালের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে : শের বাহাদুর দেউবা, খাদগা প্রসাদ অলি, পুষ্পকমল দাহাল ও কামাল থাপা। দেউবা নেপালি কংগ্রেসের নেতা। খাদগা প্রসাদ অলি ইউএমএল নেতা। পুষ্পকমল দাহাল মাওবাদীদের নেতা, আর কামাল থাপা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতা। এ চারজনের যে কোনো একজন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়েছে। বামপন্থী জোটে আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), নয়া শক্তি পার্টি। নয়া শক্তি পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই। শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাম জোটে থাকেননি গোরকা নির্বাচনী এলাকায় জোটের প্রার্থী হতে না পারায়। পরবর্তী সময়ে তিনি জোটবদ্ধ হয়েছেন অপর দুটি বাম সংগঠন- রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (এমএল) সঙ্গে। অপরদিকে নেপালি কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (গণতান্ত্রিক) এবং মাদেসি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। মোট ৮৮টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচনের পরও নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কিনা সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। বাম জোটে মাওবাদীরা ইউএমএলের সঙ্গে ঐক্য করলেও এ ঐক্য নির্বাচনের পর আদৌ থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অতীতে খাদগা প্রসাদ অলি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই সরকার পদত্যাগ করেছিল মাওবাদীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায়। এমনটি এবারও ঘটতে পারে। বাম জোট নির্বাচনে ভালো করলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে অলি-প্রচন্ড আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন! এ নির্বাচনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ দেশ দুটি নেপালি রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। দুটি দেশের সঙ্গেই নেপালের সীমান্ত রয়েছে। চীন অলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক প্রভাব কমাতে চীন নেপালের সঙ্গে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ভারত চেয়েছিল অলি সরকারের পতন (দ্য ডিপ্লোমেন্ট, ২৬ জুলাই ২০১৬)। অনেকেই মনে করেন, নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সেখানে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বেশি। সুতরাং এ নির্বাচনে দেশ দুটি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে চাইবে।
নির্বাচনে যে জোটই ভালো ফলাফল করুক না কেন, দৃষ্টি থাকবে প্রধানমন্ত্রী পদটির দিকে। তবে অলি, প্রচন্ড, দেউবা- যে কোনো একজনই আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। দেউবা এখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৫-১৯৯৭, ২০০১-২০০২, ২০০৪-২০০৫ সময়সীমায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে অলি ও প্রচন্ড নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন নারীনেত্রী বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি নেপালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও দেশটির রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা নেই। পার্লামেন্টে নারীদের জন্য কোনো ‘কোটা’ ব্যবস্থা নেই। মিসেস ভাণ্ডারি মাওবাদী নেতা ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী। তার প্রয়াত স্বামী মদন কুমার ভাণ্ডারিও ছিলেন মাওবাদীদের নেতা। সংসদে তিনি মাওবাদী গ্রুপের ডেপুটি লিডার ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
এখন দেখার পালা দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর যে ফলাফল পাওয়া যাবে, তাতে সরকার গঠনে জটিলতা এড়ানো যায় কিনা। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৮টি আসন বাম জোট নাকি গণতান্ত্রিক জোট পাবে, তার ওপর নির্ভর করছে নেপালের আগামী দিনের রাজনীতি। আগেই বলেছি, ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে নেপালে। চীনের স্বার্থ থাকলেও দেশটি সরাসরি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নেপালের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারেনি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলাদলির কারণে। গত ১০ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এখন প্রত্যাশা একটাই- সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসুক।
নেপালে একসময় রাজতন্ত্র ছিল। দীর্ঘদিন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলেছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নেপালে রাজতন্ত্রের পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ গণঅভ্যুত্থানে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ২০০১ সালের ১ জুন, তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু তিনি কখনই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। সরকার মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ এ অভিযোগ তুলে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা জ্ঞানেন্দ্র নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি। ফলে প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে তিনি তৎকালীন সাতদলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেপালে রাজতন্ত্র বাতিল ঘোষিত হয়। বলা ভালো, ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষিত হলেও সেখানে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় সরকারের স্থিতিশীলতা। গত ১০ বছরে সেখানে কয়েকটি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও প্রবল। একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা নিয়েও সমস্যা ছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে নেপালের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল চীনাপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীদের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা পরিত্যাগ করা এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। মাওবাদীরা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সাতদলীয় জোটের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সঙ্গে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল প্রচন্ড একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ চুক্তি বলে মাওবাদীরা মূলধারায় ফিরে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রচন্ড দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছিল সংবিধান প্রণয়ন করতে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেপালি রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। ১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে দীর্ঘ ৩২ বছর পর নেপালে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল, ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে সেই পার্লামেন্ট ভেঙে যায় মূলত নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। নেপালি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল মূলত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে। একদিকে ছিলেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, অন্যদিকে কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই। এ দ্বন্দ্বের কারণে শের বাহাদুর দেউবা এর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পার্টি ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কৈরালা ও ভট্টরাই কেউই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে দেউবা উঠে আসেন। দ্বন্দ্ব ছিল মাওবাদীদের মধ্যেও। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে মাওবাদীরাও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাই দু’জনেই সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী
হয়েছিলেন। মাওবাদীদের বাইরে ইউনাইটেড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টিও (ইউএমএল) নেপালের অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর পাশাপাশি মাদেসি ফ্রন্টও স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী।
এখন মূলত চার ব্যক্তিকে ঘিরে নেপালের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে : শের বাহাদুর দেউবা, খাদগা প্রসাদ অলি, পুষ্পকমল দাহাল ও কামাল থাপা। দেউবা নেপালি কংগ্রেসের নেতা। খাদগা প্রসাদ অলি ইউএমএল নেতা। পুষ্পকমল দাহাল মাওবাদীদের নেতা, আর কামাল থাপা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতা। এ চারজনের যে কোনো একজন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়েছে। বামপন্থী জোটে আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), নয়া শক্তি পার্টি। নয়া শক্তি পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই। শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাম জোটে থাকেননি গোরকা নির্বাচনী এলাকায় জোটের প্রার্থী হতে না পারায়। পরবর্তী সময়ে তিনি জোটবদ্ধ হয়েছেন অপর দুটি বাম সংগঠন- রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (এমএল) সঙ্গে। অপরদিকে নেপালি কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (গণতান্ত্রিক) এবং মাদেসি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। মোট ৮৮টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচনের পরও নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কিনা সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। বাম জোটে মাওবাদীরা ইউএমএলের সঙ্গে ঐক্য করলেও এ ঐক্য নির্বাচনের পর আদৌ থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অতীতে খাদগা প্রসাদ অলি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই সরকার পদত্যাগ করেছিল মাওবাদীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায়। এমনটি এবারও ঘটতে পারে। বাম জোট নির্বাচনে ভালো করলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে অলি-প্রচন্ড আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন! এ নির্বাচনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ দেশ দুটি নেপালি রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। দুটি দেশের সঙ্গেই নেপালের সীমান্ত রয়েছে। চীন অলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক প্রভাব কমাতে চীন নেপালের সঙ্গে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ভারত চেয়েছিল অলি সরকারের পতন (দ্য ডিপ্লোমেন্ট, ২৬ জুলাই ২০১৬)। অনেকেই মনে করেন, নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সেখানে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বেশি। সুতরাং এ নির্বাচনে দেশ দুটি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে চাইবে।
নির্বাচনে যে জোটই ভালো ফলাফল করুক না কেন, দৃষ্টি থাকবে প্রধানমন্ত্রী পদটির দিকে। তবে অলি, প্রচন্ড, দেউবা- যে কোনো একজনই আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। দেউবা এখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৫-১৯৯৭, ২০০১-২০০২, ২০০৪-২০০৫ সময়সীমায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে অলি ও প্রচন্ড নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন নারীনেত্রী বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি নেপালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও দেশটির রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা নেই। পার্লামেন্টে নারীদের জন্য কোনো ‘কোটা’ ব্যবস্থা নেই। মিসেস ভাণ্ডারি মাওবাদী নেতা ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী। তার প্রয়াত স্বামী মদন কুমার ভাণ্ডারিও ছিলেন মাওবাদীদের নেতা। সংসদে তিনি মাওবাদী গ্রুপের ডেপুটি লিডার ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
এখন দেখার পালা দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর যে ফলাফল পাওয়া যাবে, তাতে সরকার গঠনে জটিলতা এড়ানো যায় কিনা। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৮টি আসন বাম জোট নাকি গণতান্ত্রিক জোট পাবে, তার ওপর নির্ভর করছে নেপালের আগামী দিনের রাজনীতি। আগেই বলেছি, ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে নেপালে। চীনের স্বার্থ থাকলেও দেশটি সরাসরি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নেপালের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারেনি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলাদলির কারণে। গত ১০ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এখন প্রত্যাশা একটাই- সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসুক।
Daily Jugantor
08.12.2017
0 comments:
Post a Comment