ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর তাণ্ডবে বাংলাদেশে কোনো বড় ধরনের ক্ষতি না হলেও, যে প্রশ্নটি এখন বহুল আলোচিত, তা হচ্ছে এরপর কী? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে তৈরি হয়েছে আরেকটি বড় ঘূর্ণিঝড় ‘নাকরি’, যা কি না ‘বুলবুল’-এর চেয়েও ভয়ংকর। ‘নাকরি’ ধীরে ধীরে ভিয়েতনামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একপর্যায়ে তা মিয়ানমারের দক্ষিণ অংশে পৌঁছাবে এবং প্রচুর শক্তি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করবে। বিশ্ব যে বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ তার সর্বশেষ উদাহরণ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত। জন্ম হচ্ছে বুলবুলের মতো ঘূর্ণিঝড়ের। অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বলানই উত্তোলন ও এর ব্যবহারের কারণেই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেশি নির্গমন হচ্ছে, যাতে করে বাড়ছে বিশ্বের উষ্ণতা। তাই বিশ্বব্যাপী গাছ লাগানোর একটি উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড ধরে রাখতে পারে। তাই বেশি বেশি করে গাছ লাগালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন হবে কম।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সাগর-মহাসাগরের পানি বৃদ্ধি পাবে আর তাতে করে যেসব সমুদ্র পাড়ের দেশের ক্ষতি হবে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কতটুকু সচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছি? সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো জানিয়েছেন, দেশটি দুই বিলিয়ন গাছ লাগাবে। নরওয়ে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করেছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (crwother Lab) জানিয়েছে, বিশে^র ২ দশমিক ২ বিলিয়ন একর জমিতে যদি গাছ লাগানো যায়, তাহলে বিশে^ যে কার্বন নির্গমন হয়, তার ৩ ভাগের ২ ভাগ ধরে রাখতে পারবে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করার জন্য ২০১৫ সালের কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ ব্যাপারে উদ্যোগটা কম। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ দায়ী নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্ব। শিল্পোন্নত ১০টি দেশ বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ৬৭ দশমিক ৬ ভাগ নিজেরা নিঃসরণ করে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন। দুঃখজনক হচ্ছে, কপ-২১-এ যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সারা বিশ্ব যেখানে এটা স্বীকার করে নিয়েছে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি দায়ী, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত সত্যকে বিশ্বাস করতে চাইছেন না। বলা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প লানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। মরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে করে বাড়ছে সাগর-মহাসাগরের জলরাশি।
World Meteological Organizatin (WMO)-এর সর্বশেষ রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতীতের চেয়ে ২০১৫-১৯ সময়সীমায় ২০ ভাগ হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে যেখানে সাগরের জলসীমার উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩ দশমিক ২ মিলিমিটার, সেখানে ২০১৫-১৯ সময়সীমায় বেড়েছে পাঁচ মিলিমিটারের ওপর (এবিসি নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর)। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বারবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো আতঙ্কের মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে বড় রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তা পালন করছে না। জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই যে, বিশ্বের উষ্ণতা রোধে জাতিসংঘ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সুতরাং ভয়টা এখানেই। কিশোরী গ্রেটা থুনবারি যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, তা কতটুকু আবেদন রাখতে পারবে? ইকোনমিস্টের একটি কভার স্টোরি। The climate Issue (২১ সেপ্টেম্বর)। এই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কীভাবে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাময়িকীটি একটি তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। ব্যক্তিপর্যায়ে এর পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ৩ গিগাটন, মধ্যপ্রাচ্য ২ দশমিক ৭ গিগাটন, ইউরোপ ৪ দশমিক ৯ গিগাটন, চীন ৯ দশমিক ৮ গিগাটন, এশিয়া প্যাসিফিক ৫ দশমিক ১ গিগাটন, ভারত ২ দশমিক ৫ গিগাটন ইত্যাদি ( বিশ্বের গড় ৪ দশমিক ৬ গিগাটন, ২০১৭ সালের হিসাবে)। বিকল্প জ্বালানির অভাব এবং না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। দুঃখজনক হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা উপলব্ধি করেন না। তাই তিনি যখন কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, তার বিবেচনায় এটা ছিল না। তবে এটা ঠিক, বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন, গবেষণা ইত্যাদির দিকে তিনি নজর দিতে পারতেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলোতে উষ্ণতা বৃদ্ধর ফলে যে ক্ষতি হবে, তা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সোলার বা বায়ু এনার্জির প্রসার ঘটিয়ে তারা এনার্জি চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ সাগর পাড়ের দেশগুলো? অনেক দেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। প্যারিস কপ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নত দেশগুলো পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়নশীল, বিশেষ করে সাগর পাড়ের দেশগুলোকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি গত চার বছরেও। বলা ভালো, উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্ব জিডিপির ৭৫ শতাংশ আর তারা কার্বন নিঃসরণ করে ৬৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ এসব উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছেন। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবেন। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে (২০০৯) এসব উদ্বাস্তু মানুষকে Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এ দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশ জাতিসংঘে এ দাবি আবারও উত্থাপন করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে তার উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন। এবার বাংলাদেশ অর্থায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেও অভ্যন্তরীণভাবে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ দিয়েছে কম। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগটা কম। বন অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগও আজ চোখে পড়ছে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের একটি কাজে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত কিন্তু পরিবেশ কিংবা বন মন্ত্রণালয়, কারও কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
গাছের কোনো বিকল্প নেই। গাছ লাগানোর ব্যাপারে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। নিউজিল্যান্ড সরকার ১০০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য (Educate Inspire Change, ১৯ আগস্ট) দেশটি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায়। এ জন্য গাছ লাগানোর ওই পরিকল্পনা। ফিলিপাইন নতুন একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যাতে একজন শিক্ষার্থী ১০টি গাছ না লাগালে তাকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি দেওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে আইনটি ফিলিপাইনের আইন সভায় পাসও হয়েছে (Insider, ২৯ মে ২০১৯)। ভারতের দৃষ্টান্ত দিই। উষ্ণতা রোধকল্পে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে স্কুলশিক্ষার্থীরাসহ সবাই এক দিনে ২২ কোটি গাছ লাগিয়েছেন। অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের মোট বাসিন্দা ২২ কোটি। সবাই একটি করে গাছ লাগিয়েছেন ১৪৩০৩৮১টি জায়গায়, যার মধ্যে আছে ৬০ হাজার গ্রাম আর ৮৩ হাজার জঙ্গল চিহ্নিত এলাকা। এই তথ্যটি দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ( USA Today, ৯ আগস্ট, ২০১৯)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু পরিবেশ বা বন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ তাই আমাদের জানান দিয়ে গেল, আমাদের উদ্যোগটা নিতে হবে অতিদ্রুত। সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ৩৫তম আসিয়ান সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হবে দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষের ক্ষতি হবে। একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই শতাব্দীতে কার্বন নিঃসরণের হার কমিয়ে না নিয়ে এলে বৈশি^ক তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আগামী ১০ বছরে এই হার ৪৫ শতাংশ না কমালে বিপর্যয় অবধারিত। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ বড় ক্ষতি আমাদের করেনি, এটা সত্য; কিন্তু আমাদের জন্য তা চিন্তার কারণ। যদিও এটা সত্য, বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য আমরা কোনো মতেই দায়ী নই। উন্নত বিশ্বের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো, বিকল্প জ্বালানিতে উৎসাহিত করা, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ কমিয়ে আনা, পরিবহনে ‘দিল্লি মডেল’ অনুসরণ করা ইত্যাদি নানা কর্মসূচি নিয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। নিউজিল্যান্ড ‘জিরো কার্বন’ আইন সংসদে অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডের দৃষ্টান্তটি ভেবে দেখতে পারেন। একটি ‘টাস্কফোর্স’ গঠন করাও জরুরি। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আমাদের এই মেসেজটিই দিয়ে গেল।
Daily Desh Rupantor
16.11.2019
0 comments:
Post a Comment