রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আইসিজিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে


advertisement
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার আদৌ সমাধান হবে কিনা? একই সঙ্গে মিয়ানমারের 
রোহিঙ্গা গণহত্যায় যারা জড়িত, তাদের বিচার করা সম্ভব হবে কিনা? ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হলে এর ব্যাপকতা ও গণহত্যার খবর বিশ্বব্যাপী আলোচিত হলেও গণহত্যার জন্য এই প্রথম মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেল 
তথা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইসিজিতে মামলা করা হলো। মামলাটি করেছেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তাম্বাদো। দেশটি অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) 
অ্যাডহক মিনিস্টারিয়াল কমিটির প্রধান। জুনে ওআইসি এ কমিটিকে আইসিজিতে অভিযোগ দায়েরের দায়িত্ব দিয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই গাম্বিয়া এই মামলাটি করে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ১৯৪৫ সালে আইসিজি প্রতিষ্ঠিত 
হয়। সাধারণত আইসিজি দুইভাবে কাজ করে। এক. দুই বা একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে যদি আইনগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা হলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সংস্থাটি তা সমাধান করে। দুই. জাতিসংঘের কোনো সংস্থা যদি 
আইনগত কোনো সহায়তা চায়, সংস্থাটি তখন ওই সংস্থাকে ‘উপদেশ’ তথা আইনগত সহায়তা দেয় (দাগ হ্যামারজোলড লাইব্রেরি)। এখানে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আইসিজিতে যোগ 
দিলেও মিয়ানমার বলছে, আইসিজির কোনো অধিকার নেই এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার। তারা এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিয়ানমারের সরকারি মুখপাত্র জ’টয়ে (তধি ঐঃধু) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, 
এ ধরনের একটি আদালত গঠন করার ব্যাপারে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, মিয়ানমার এতে স্বাক্ষর করেনি। তাই ওই কোর্টের আদেশ মানতে মিয়ানমার বাধ্য নয় (ট.ঝ. ঘবংি ১৬ ঘড়াবসনবৎ ২০১৯)। ২০১৭ সালে 
অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হয়ে সাত লাখের ওপর রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারের মুখপাত্র জানান, মিয়ানমার কাউকে জোর করে বিতাড়িত করেনি। বলা ভালো, গাম্বিয়া 
আইসিজিতে যে অভিযোগে করেছে, এতে বলা হয়েছেÑ ‘সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে মিয়ানমার জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন (১৯৪৮) লঙ্ঘন করেছে।’ ৪৬ পৃষ্ঠার 
অভিযোগপত্রের নথি সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সামাজিক ভিত্তি ধ্বংস করেছে। হত্যা ও ধর্ষণও করেছে। এখন মিয়ানমার সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, 
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ৪৪৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়Ñ হত্যা, গণধর্ষণ, শারীরিক লাঞ্ছনার ব্যাপক প্রমাণ 
রয়েছে। এসব কর্মকা- মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যাবিষয়ক বিচারের আওতায় পড়ে। শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে তদন্ত ও বিচারের কথা বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। মিয়ানমার 
সরকার এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনকেও বানোয়াট বলেছে। এখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিজি নিয়েও কথা বলা দরকার। রোম স্ট্যাটিটিউট অনুযায়ী আইসিজি গঠিত হয় ২০০২ সালে। ১৯৯৮ সালের 
১৭ জুলাই ইতালির রাজধানী রোমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ১২২টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। রোম স্ট্যাটিটিউটে ৪টি অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়েছে। 
এগুলো হচ্ছে জেনোসাইড বা গণহত্যা, ক্রাইম এগেইনিস্ট হিউমেনিটি বা মানবতাবিরোধী অপরাধ, ওয়ার ক্রাইম বা যুদ্ধাপরাধ এবং ক্রাইম অর অ্যাগরিশন বা আক্রমণ সংক্রান্ত অপরাধ। মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর 
করেনি। তবে আইসিজিতে স্বাক্ষর করেছে। রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর না করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের বিচার করা যাবে কিনা, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন।
আইসিজি সাধারণত দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করে থাকে। যেমনÑ বলা যেতে পারে, ক্যামেরুন বনাম নাইজেরিয়ার মধ্যকার বিরোধ কিংবা ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার মধ্যকার বিরোধের মীমাংসা করেছে আইসিজি। 
আইসিজি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে (২২ মে ১৯৪৭) ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত আইসিজি ১৭৭টি মামলার শুনানি শুনেছে ও রায় দিয়েছে। আইসিজি জাতিসংঘের একটি সংস্থা এবং সংস্থাটির যে কোনো সিদ্ধান্ত মানতে 
সদস্যভুক্ত দেশগুলো বাধ্য। এখানে স্পষ্টতই একটি বিষয় লক্ষণীয়Ñ তা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। ফলে গণহত্যাসংক্রান্ত গাম্বিয়ার অভিযোগ আইসিজি বিচার করতে পারবে কিনা, 
এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আইসিজির ইতিহাস বলে এই আদালত ইতোমধ্যে ৪৪ দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়েছে এবং ৩৬ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আইসিজি যাদের ‘গণহত্যা’ ও 
‘যুদ্ধাপরাধের’ বিচার করেছেÑ তারা মূলত কঙ্গো, উগান্ডা, সেন্ট্রাল আফ্রিকার রিপাবলিক, দারফুর-সুদান, কেনিয়া, মালি, আইভরিকোস্ট, বরুন্ডির নাগরিক।
গাম্বিয়া আইসিজিতে যে মামলা করেছে, এ ব্যাপারে মিয়ানমারের আপত্তি কিংবা মিয়ানমার তা প্রত্যাখ্যান করলেও আমরা বসনিয়া হারজেগোভিনায় গণহত্যার দায়ে যে মামলা হয়েছিল, এর দৃষ্টান্ত দিতে পারি। বসনিয়ার 
মুসলমানÑ যারা বসনিয়ান হিসেবে পরিচিত, এক সময় সাবেক যুগোসøাভিয়ার অংশ ছিল। বসনিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার জন্য সার্বিয়ার খ্রিস্টধর্মের অনুসারী সার্বদের দায়ী করা হয়েছিল। এ 
ব্যাপারে আইসিজিতে অভিযোগ করা হলে (বসনিয়ার পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগ) ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আইসিজি তাদের রায়ে ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই সেব্রানিয়াসকার হত্যাকা-কে 
গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তবে এই হত্যাকা-ের জন্য সার্বিয়াকে আইসিজি দায়ী করেনি। আইসিজি তাদের রায়ে বলেছে, সার্বিয়া এই গণহত্যা এড়াতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু তারা তা নেয়নি। এমনকি 
যারা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল, তাদের শাস্তি দিতেও পারেনি। সেব্রানিসকায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছিল সার্বিয়ার আধা মিলিশিয়া বাহিনী। ওই সময় মুসলমানদের রক্ষায় সেখানে 
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ছিল। সার্বরা তাদের সেখান থেকে উৎখাত করে সেব্রানিসকায় গণহত্যা চালায় (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। এখন গাম্বিয়ার করা মামলায় কী হবে বলা মুশকিল। কেননা 
মিয়ানমার যখন এই আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তখন আদালতের শুনানিতে মিয়ানমার অংশ নেবে বলে মনে হয় না। ফলে এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। 
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলে এলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের মধ্যস্থতার একটি উদ্যোগও আমরা লক্ষ করেছি। 
কিন্তু মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে না। আলোচনার নামে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কিংবা চীনের মধ্যস্থতার মধ্যেও বাংলাদেশে অবস্থানরত 
রোহিঙ্গারা একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। মিয়ানমারের কোনো 
ডকুমেন্টে রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত নেই। তারা এদের বলছে ‘বাস্তুচ্যুত নাগরিক’। বাংলাদেশের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতেও উল্লেখ আছে বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে। চীন একটি মধ্যস্থতার সুযোগ নিলেও 
এখন অবধি মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারেনি। ফলে বিষয়টি ঝুলে আছে। এমনকি ভারতও মিয়ানমারের ওপর বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কারÑ তারা হয়তো গুটিকয়েক 
রোঙ্গিাকে ফেরত নেবে। একটা বড় অংশকেই তারা ফেরত নেবে না। এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ‘চাপ’ আছে মিয়ানমারের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র কয়েকজন শীর্ষ সেনা কমান্ডারের ব্যাপারে 
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এতে করে মিয়ানমারের ওপর আদৌ কোনো ‘প্রেসার’ খাটানো যাচ্ছে না। যতদিন পর্যন্ত না মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ 
আরোপ করা যায়, ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমার রোঙ্গিাদের ফেরত নেবে না। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হলেও চীন ও জাপানের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ব্যক্তিরা নিয়মিত মিয়ানমার সফর করছেন। চীন ও জাপানের 
বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। তাই আইসিজিতে গাম্বিয়ার মামলা দায়ের ও মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে খুব সহসাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না
Daily Amader Somoy
24.11.2019

0 comments:

Post a Comment