advertisement
ইসলামিক স্টেটের শীর্ষ নেতা আবু বকর আল বাগদাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি আইএস যুগের অবসান হতে যাচ্ছে? নাকি আগামীতে আমরা আরও ‘একজন বাগদাদি’কে পাব, যিনি আরও বেশি মাত্রায় সহিংস পন্থায় সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন? এসব প্রশ্ন এখন সঙ্গত কারণেই উঠেছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ‘টুইন টাওয়ার’ যখন ধ্বংস হয়, তখন সারাবিশ্বের মানুষ জেনেছিল একটি নাম-আল কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেন। নিজের আর্থিক ভিত্তি ও ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে নতুন একটি মাত্রা তিনি আনলেন। সারাবিশ্বে একটা ‘ইমেজ’ তৈরি করা হলো যে, ইসলাম ধর্ম আর মানবিকতার ধর্ম নয়! ইসলাম ধর্ম অশান্তি সৃষ্টি করে, আর সন্ত্রাসী তৈরি করে! একজন লাদেনকে দিয়ে সারাবিশ্বের মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো হলো। সেই প্রোপাগান্ডা আজও আছে।
পশ্চিমা বিশ্বে আজও মুসলমানরা এক ধরনের নিগ্রহের শিকার। সেই লাদেনকে খুঁজে পাওয়া গেল ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যামোটাবাদ শহরে। মার্কিন নেভি-সিলের কমান্ডোরা তাকে হত্যা করল, মৃতদেহ ফেলে দিল সাগরে। এর পর মাত্র তিন বছর অপেক্ষা। ২০১৪ সালে ইরাকের মসুলে প্রাচীন আল নূরী মসজিদে আবির্ভাব হলেন আরেক ব্যক্তি, যাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো আবু বকর আল বাগদাদি হিসেবে। যদিও এই নামটি তার আসল নাম ছিল না।
ওইদিন মানুষ জানল আইএস বা ইসলামিক স্টেট নামে একটি সংগঠনের কথা। বাগদাদি আহ্বান জানালেন একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার। আল নূরী মসজিদে দেওয়া ‘খুতবায়’ বাগদাদি বললেন, বিশ্বের সব মুসলমানের উচিত তার নেতৃত্বে খিলাফত প্রতিষ্ঠায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করা! একজন বাগদাদিকে মানুষ তেমন একটা চিনত না। তিনি ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আলি আল বদরি আল সামাররাই, তিনি হয়ে গেলেন আবু বকর আল বাগদাদি। তিনি ছিলেন একজন একাডেমিশিয়ান। ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসন হলে তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন।
২০০৪ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জেলে থাকা অবস্থাতেই আল কায়েদার সংস্পর্শে আসেন। একপর্যায়ে জেল থেকে মুক্তি পান এবং আল কায়েদার কয়েকজন শীর্ষ নেতার একজনে পরিণত হন। একপর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন আইএসআইএল বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট।
প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলের নাম ছিল লেভেন্ট। বাগদাদি পুরো আরব বিশ্বকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যেই লেভেন্ট নামটি নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে যা শুধু আইএস বা ইসলামিক স্টেট নামে পরিচিতি পায়। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল মাত্র এই তিন বছরে আইএস কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, তা প্রত্যক্ষ করেছে সারাবিশ্ব। তিনি সন্ত্রাসবাদের নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। এখানে আল কায়েদার সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আল কায়েদা গুপ্ত হামলা চালাত, অন্যদিকে আইএস একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও একটি জিহাদি সেনাবাহিনী পর্যন্ত গড়ে তুলেছিল।
এরা যে কত সহিংস হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটি ঘটনায়। বাগদাদি যেভাবে আইএসকে পরিচালনা করতেন, অন্য কেউ এভাবে এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন পরিচালনা করেনি। তিনি অত্যন্ত নৃশংস একটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন। মানুষ পুড়িয়ে মারার বাহিনী তারা নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করত। এর মধ্য দিয়ে তারা একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছিল। অনেক ইয়াজিদিস নারীকে তারা ধরে এনে ‘যৌন দাসীতে’ পরিণত করেছিল। এসব নারীর করুণ কাহিনি পশ্চিমা সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। তারা একটি সশস্ত্র বাহিনীও তৈরি করেছিল, যারা ‘যুদ্ধে’ নিয়মিত অংশ নিত। আল কায়েদার সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা ছিল এখানেই। ইসলামের নামে তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে জড়িত থাকলেও আইএসের স্ট্র্যাটেজি ছিল ভিন্ন। এখন বাগদাদির মৃত্যু ঘটল। কিন্তু রেখে গেল অনেক প্রশ্ন। আগামী দিনগুলোতে এই প্রশ্নগুলো বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে।
একজন নতুন আইএস নেতার নাম পাওয়া গেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যে নামটি এসেছে, তা হচ্ছে আবু ইব্রাহিম আল হাশিমি আল কোরাইশি। আইএসের অডিও বার্তায় এই নতুন নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এটা বলার চেষ্টা করেছে যে, নবী করিম (সা.) এই কোরাইশি গোত্রের মানুষ ছিলেন। সেই গোত্রের একজনকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ (ঙতণ নিউজপোর্টাল, ১ নভেম্বর)। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আবু ইব্রাহিম, এটাও একটি ‘ফেক নেম’ অর্থাৎ ভুয়া নাম। তার প্রকৃত পরিচয় পেতে আমাদের আরও কিছু সময় লাগবে। তবে নতুন নেতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হল যে, আইএস বিলুপ্ত হচ্ছে না!
নিঃসন্দেহে বাগদাদি ভুল করেছিলেন। ভুল করেছিলেন ওসামা বিন লাদেনও। আর তালেবানরাও ভুল করছে। আফগানিস্তানের এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- এখন ছড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকাতে। নাইজেরিয়াতে বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল শাবাব গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার ছাপা হয়েছে। বোকো হারাম আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু তার পরও তারা বোকো হারামকে নাইজেরিয়া থেকে উৎখাত করতে পারেনি। আর সোমালিয়া একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
ফলে একটা প্রশ্ন থাকবেইÑ বাগদাদি-পরবর্তী ওইসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ হবে কিনা? আমরা আফগানিস্তানের কথাও বলতে পারি। আফগানিস্তানের একটা বিশাল এলাকা তালেবানদের দখলে থাকলেও আইএস জিহাদিদের একটা অংশ সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাত হয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের কর্মকাণ্ড ও মাঝে মধ্যে সংবাদের জন্ম দেয়। আইএসের সংবাদমাধ্যমে আইএসের পাক-ভারত উপমহাদেশের শাখা গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। একজন আমিরের নামও (ছদ্মনাম) তারা ঘোষণা করেছিল। এখন তাদের কী হবে? বাস্তবতা হচ্ছে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়েদা বিলুপ্ত হয়নি। জওয়াহিরির নেতৃত্বে আল কায়েদা এখন সংগঠিত হয়েছে। ওসামা বিন লাদেনের পর বাগদাদি যুগের অবসান ঘটল।
এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে সন্ত্রাসী যুগের অবসান হোক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় নাÑ বাগদাদির মৃত্যু এই সত্যটি আবার প্রমাণ করল। তবে একটা মৌলিক প্রশ্ন এখানে আছে। আর তা হচ্ছে বাগদাদি-পরবর্তী রাজনীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? অর্থাৎ ‘নাইন-ইলেভেনের’ পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেই যুদ্ধের অবসান হবে কিনা? সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো সমস্যায় আছে। আফগানিস্তান থেকে তিনি পরিপূর্ণভাবে বের হয়ে আসতে পারছেন না। তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনারও জট খুলছে না। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখন অবধি ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। লেবানন আর ইরাকে অসন্তোষ বাড়ছে। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আদৌ পরিবর্তন হয় কিনা, সেটা দেখার বিষয়। আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ধরনের ‘ইমপিচমেন্ট’র সম্মুখীন হয়েছেন। প্রতিদিনই এটা নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাগদাদিকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে এবং তাকে হত্যা করে জনমত তার পক্ষে নিতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। আগামী নির্বাচনে এটা তার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তবে যেতে হবে অকেন দূর। শুভবুদ্ধির প্রতিটি মানুষকে এখন এগিয়ে আসতে হবে। ইউরোপে আইএসের ‘সিøপার সেল’ আছে। অর্থাৎ ইউরোপের মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা অংশ, তারা সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর ইউরোপে ফিরে এসেছে। সেখানে তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছে। এদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে আমাদের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। যদিও আইএসের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা আমরা রুখে দিতে সক্ষম হয়েছি। এটা আমাদের একটা সফলতা। কিন্তু তাই বলে আমরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি না। সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা- আমাদের বাড়াতে হবে। হলি আর্টিজানের ঘটনায় বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। এখন বাগদাদির মৃত্যুর পর আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, আমরা ভুল করব।
সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাগদাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Foreign policy research institute-এর গবেষক ক্লিনট ওয়াটাস তাই মন্তব্য করেছেন এভাবেথ ‘The death of enigmatic leaders after releases distant middle managers to pursue their own violent campaigns and spearhead emerging groups' অর্থাৎ একটা আশঙ্কা থাকলেই আইএস নানা গ্রুপে এঔন বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে এতে করে শক্তি কমবে, কিন্তু সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হবে না।
Daily Amader Somoy
09.11.2019
0 comments:
Post a Comment