Jugantor ০৯ নভেম্বর ২০১৯, প্রিন্ট সংস্করণ
কোন পথে এখন ভারত? গত ৫ আগস্ট কাশ্মীর সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত সংক্রান্ত একের পর এক যেসব সংবাদ ছাপা হচ্ছে, তা দেশটির অখণ্ডতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের কোনো ভালো সংবাদ দেয় না।
কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয়ার পর সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত, তা বলা যাবে না। ইতিমধ্যে কাশ্মীরে কেন্দ্রের শাসন চালু হয়েছে এবং লাদাখ আলাদা হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে গত ২৯ অক্টোবর লন্ডন থেকে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ভারতের রাজ্য মনিপুরের রাজা লেইশেমবা সানাজাওবার পক্ষ থেকে ভারতীয় যুক্তরাজ্য থেকে মনিপুরের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
একটি প্রবাসী সরকারও সেখানে গঠন করা হয়েছে, যাকে তারা বলছে ‘মনিপুর স্টেট কাউন্সিল’। এ কাউন্সিলের প্রধান হচ্ছেন ইয়ামবেন বীরেন, আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারেন্গবাম সমরজিত। সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, ১৯৪৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশরাজ যে ডিক্রি জারি করেছিলেন, তাতে মনিপুরকে বাদ রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার মনিপুরকে ১৯৪৯ সালের আইন অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে একীভূত করে (জিইও.টিভি, ২৯ অক্টোবর ২০১৯)।
তবে খুব কম ভারতীয় সংবাদপত্রে এটি ছাপা হয়েছে। মনিপুরে এর খুব একটা প্রতিক্রিয়া পড়েছে বলেও আমার চোখে ধরা পড়েনি। তবে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছিল এর আগে। ১৪ আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ওইদিন নাগাল্যান্ড রাজ্যজুড়ে উড়তে দেখা গেছে নাগা জাতীয় পতাকা। সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে, ওই দিন সেনাপতি জেলায় কয়েক হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ‘নাগা স্বাধীনতা দিবস’ও পালন করে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এ সংক্রান্ত ছবিও ছাপা হয়েছে।
যারা ভারতের এ অঞ্চলের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, আসাম ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে ‘নাগা স্বাধীন ভূমি’ বা ‘নাগালিম’ গড়ার ডাক বহুদিনের পুরনো। এ দাবিতে তারা সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএসসিএনের নেতৃত্বে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালিত হলেও সংগঠনটি ইতিমধ্যে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
মুইভা গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বলা ভালো, এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি গত ৮ মার্চ দ্য হিন্দু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ। তাতে বলা হয়েছে, কর্নাটক রাজ্য তাদের নিজস্ব পতাকা প্রদর্শনের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্নাটকের রাজ্য সরকার এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এর আগে কর্নাটক সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার এ সিদ্ধান্তটি নিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কর্নাটক রাজ্যের এ সিদ্ধান্ত অন্য রাজ্যগুলোয় আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা? কিংবা এ সিদ্ধান্ত কর্নাটককে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেবে কিনা? বলার অপেক্ষা রাখে না, কাশ্মীর-সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়েই একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যা চিন্তার কারণ। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং সেই সঙ্গে ৩৫-এ ধারা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর আলাদা মর্যাদা পেত।
এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ (স্থানীয়দের চাকরি-শিক্ষা ক্ষেত্রে সুবিধা, স্থায়ী নাগরিকের মর্যাদা ইত্যাদি) শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল তেমনটি নয়, অন্য বেশকিছু রাজ্য এখনও সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ ভোগ করে থাকে।
৩৭১-এ ও ৩৭১-জি ধারা বলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জমির ওপর, বন ও খনিজসম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকৃত। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এ অঞ্চলে সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর নয়। সেখানে দেশীয় আইন, ঐতিহ্য অনুযায়ী অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্পত্তি ও জমির হস্তান্তরও নিজস্ব নিয়মে চলে।
সংবিধানের ৩৬৮ ধারার ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর ধারায় নয়টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও অন্ধ্রপ্রদেশ রয়েছে সেই তালিকায়। ৩৭১-বি ধারায় কিংবা ২৪৪-এ ধারায় আসাম বেশকিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ৩৭১-ডি ও ই ধারায় অন্ধ্রপ্রদেশে শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণসহ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ৩৭১-এইচ ধারামতে অরুনাচল রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারেন কেন্দ্র থেকে নিযুক্ত রাজ্যপাল।
সুতরাং যেসব অঞ্চল বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে, তাদের মাঝে কাশ্মীরের ঘটনার পর এক ধরনের আতঙ্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে নাগাল্যান্ডের পাশাপাশি মিজোরামে বিক্ষোভ হয়েছে এবং স্থানীয় নেতারা কঠোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জম্মু ও কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় অনেক রাজ্যেই এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি প্রকাশ্যে এসেছে। দার্জিলিংয়ের পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চ্চার বিমল গুরং আত্মগোপন স্থল থেকে এক বার্তায় দার্জিলিংকেও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জনিয়েছেন। এটা একটা অশনিসংকেত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এ ধরনের দাবি উঠতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কি শুধু ‘মিশন কাশ্মীর’ নিয়েই ক্ষান্ত থাকবে? নাকি অন্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সংবিধানে যে সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তা খর্ব করারও উদ্যোগ নেবে? কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে জনঅসন্তোষ গড়ে উঠছে, তা যদি কেন্দ্র বিবেচনায় নেয়, তাহলে তারা অন্যান্য ও পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলোর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংবিধানে বর্ণিত রক্ষাকবচগুলো বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত মুসলমানবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো অন্য রাজ্যগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আমরা যদি মনিপুরের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব ভারতের স্বাধীনতার আগে এ এলাকার পরিচিত ছিল Princely State হিসেবে। ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, তখন ৫৬৫টি এ ধরনের ছোট ছোট রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। রাজা, মহারাজা, রাজপুত, নওয়াবরা এ রাজ্যগুলো শাসন করত।
মনিপুর ছিল তেমনই এটি রাজ্য। ১৯৩০ সালের পর থেকেই রাজ্যের শাসকরা ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল, যাতে তাদেরকে তৎকালীন বার্মা ও আজকের মিয়ানমারের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। ১৯৪৭ সালের ১ আগস্ট মনিপুরের মহারাজা বুধাচন্দ্র ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির প্রশ্নে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে Instrument of Accession হিসেবে।
এর রেশ ধরেই ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মনিপুর ভারতে যোগ দেয় (পার্ট সি-ভারতের সংবিধান; ১০ এলাকার সংযুক্তি নিয়ে। সংবিধানের ৭ম সংশোধনীর ফলে রাজ্যগুলোকে ভাষাগতভাবে A, B, C I D- এই চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়)। কিন্তু এই সংযুক্তি মনিপুরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় এবং এর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন চলে আসছে।
মনিপুরে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের খবর পাওয়া যায়, যারা মনিপুরকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চায়। এরা মনে করেন, ১৮৯১ সালের Anglo-Manipur যুদ্ধের পর মনিপুর তার স্বাধীন অস্তিত্ব হারিয়েছিল। তারা মনিপুরকে আগের অবস্থায় দেখতে চায়। ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে United National Liberation Front (UNLF)-এর কথা প্রথম জানা যায়। পরবর্তীকালে People's Liberation Army of Manipur (PLA), People's Revolutionary Party of Kangleipak, Kangleipak Communist Party ইত্যাদি সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার সেখানে Armed Forces Special
Powers Act, 1958 আরোপ করে এবং মনিপুরকে একটি ‘area of disturbance’ বা গোলযোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে মনিপুর অশান্ত। প্রায় ৩০ লাখ অধিবাসীর এ রাজ্যটিতে Meitei জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। এদের সঙ্গে কেন্দ্র আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লন্ডনে যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? এটা ঠিক, যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী দল স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য লড়ছে, তারা এই প্রবাসী সরকার গঠন করেনি। তাদের যৌথ উদ্যোগে এ প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে, এমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। তবে একটি জঙ্গি সংগঠন ‘প্রেপাক’ (পিপলস রেভ্যুলেশনারি পার্টি অব কাংলেইপাক) এ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
মনিপুর রাজ্যে এখন বিজেপি ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং পুরো বিষয়টিকে ভারতবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদিকে নাগাদের সঙ্গে ভারত সরকারের আলোচনায় বৃহত্তর নাগালিমের একটি দাবি উঠেছে। সেই দাবিতে মনিপুরের একটি অংশকে কেটে নাগালিমের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও রয়েছে। ফলে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারত সরকার এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই দেখার বিষয়
tsrahman@gmail.com
- সর্বশেষ
- সর্বাধিক পঠিত
0 comments:
Post a Comment