ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে গত শনিবার। এই নির্বাচনে খুব কমসংখ্যক মানুষ অংশ নেওয়ায় ও নির্বাচনে বেশ কিছু ত্রুটি থাকায় এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ভোটে অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।' আর একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মন্তব্য করেছেন, 'সব রাজনৈতিক দল আলোচনার টেবিলে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। তা না হলে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ।' তবে কম ভোট পড়াকে তিনি স্বাভাবিক বলেই মনে করেন। কিন্তু তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, 'কম ভোট পড়া গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত হতে পারে; কিন্তু এটাই বাস্তবচিত্র।'
সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো এমন একসময়, যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। যদিও সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চার মূল্যায়ন করা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা তো পাওয়া যায়। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্টের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের অবস্থান (১৬৭ দেশের মাঝে) দেখিয়েছিল ৮০ নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছিল 'হাইব্রিড ডেমোক্রেসি' ক্যাটাগরিতে (ইকোনমিস্ট, ২২ জানুয়ারি ২০২০)। 'হাইব্রিড' অর্থ অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ইকোনমিস্ট জানাতে চেয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণ নয়।
মোট ৪টি ক্যাটাগরিতে বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশকে ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। যেমন পূর্ণ গণতন্ত্র (৯.৮৭ পয়েন্ট নিয়ে নরওয়ে শীর্ষে), ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (৮ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে শীর্ষে), অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র বা সরকারব্যবস্থা (উত্তর মেসিডোনিয়া ৫.৯৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে), আর কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থা (৩.৯৩ পয়েন্ট নিয়ে জর্ডান রয়েছে শীর্ষে)। বাংলাদেশের পয়েন্ট ৫.৮৮। বাংলাদেশকে 'হাইব্রিড' শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রিডম হাউস ২০১৯ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে 'পার্টলি ফ্রি'। এখানে তিন ক্যাটাগরিতে দেশগুলোকে ভাগ করা হয়েছে- ফ্রি, পার্টলি ফ্রি, নট ফ্রি। সামগ্রিক বিচারে দেশগুলো কতটুকু স্বাধীন, তা মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেমন- নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকারি ব্যবস্থা, মিডিয়া কতটুকু স্বাধীন, আইনের শাসন কতটুকু আছে- এসব বিবেচনা করেই দেশগুলোর 'স্বাধীনতা' ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে।
আবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ২০১৯ সালের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করেছে। এতে শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে, এক নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান এখানে ১৫০ নম্বরে (মোট ১৮০টি দেশ জরিপে স্থান পেয়েছে)। প্রেস ফ্রিডম ইনডেস্কে যেখানে নরওয়ের স্কোর ৭.৮২, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৫০.৭৪ (সর্বনিল্ফেম্ন অবস্থানকারী তুর্কমেনিস্তানের স্কোর ৮৫.৪৪)। বাংলাদেশের নিচে অবস্থান সিঙ্গাপুরের। অর্থাৎ সেখানে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। আবার বাংলাদেশের ওপরে স্থান পাওয়া কম্পোডিয়া (১৪৩), পাকিস্তান (১৪২), মিয়ানমার (১৩৮), উগান্ডা (১২৫)- সংবাদমাধ্যম আমাদের চেয়ে স্বাধীন, এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে।
গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে, এটা সত্য। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স ২০১৮ উদ্ৃব্দত করতে পারি; যেখানে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়ন প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান আমরা দেখি ৪৮ নম্বরে (সর্বনিল্ফেম্ন আছে ইয়েমেন ১৪৯ নম্বরে ও ০.৪৯৯ স্কোর নিয়ে)। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে অর্থাৎ ১ নম্বরে আছে আইসল্যান্ড, স্কোর ০.৮৫১। এখানে ৪ ক্যাটাগরিতে এই র্যাংকিং করা হয়েছে (অর্থনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ, শিক্ষা অর্জন, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন)। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেক কম, ৫ নম্বরে। আইসল্যান্ড যেখানে ১ নম্বরে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে থাকায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
আমরা আরও অনেক তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝাতে পারব। প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হলেও এর ফল নিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। এই নির্বাচনের প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এটি অংশীদারিত্বমূলক হয়েছে। অর্থাৎ বড় দলগুলো সবাই অংশগ্রহণ করেছে; বিশেষ করে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। খুন-খারাবির ঘটনাও তেমন ঘটেনি। তৃতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বড় দলগুলো নির্বাচনে প্রচার চালাতে পেরেছে। কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয়নি। চতুর্থ প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, নির্বাচনের পর বিএনপি কোনো সহিংস রাজনীতি উস্কে দেয়নি। কিন্তু মাইনাস পয়েন্ট বোধ করি অনেক।
ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহূত হয়েছে; কিন্তু এটা বিতর্ক বাড়িয়েছে। অনেক ভোটার ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে অন্যরা ভোট দিয়েছেন- এমন খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। গোপন কক্ষে সরকারি দলের কর্মীদের দেখা গেছে। তারা ভোটারদের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন কিংবা নিজেরাই ভোটারদের আঙুলের ছাপ নৌকা মার্কায় 'পুশ' করেছেন- এসব পত্রিকার খবর। খোদ সিইসির এনআইডি ইভিএম শনাক্ত করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয় যে, শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে ইসি ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি কেন নিল? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের অনেক বক্তব্য ইসির সভায় তিনি আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। ইভিএমের ব্যবহার (শতভাগ) রাখা বা না রাখার প্রশ্নটিও ছিল। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে তিনি গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন। অপর একজন কমিশনারও বলেছিলেন, 'ভোটকেন্দ্র দখলে থাকলে' ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব! সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছিল কিছুদিন আগে- ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব কিনা, তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ওই কমিটিতে থেকেও তদন্ত কমিটির রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি। একজন সাংবাদিক এই তথ্যটি টিভি সংলাপে দিয়েছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইভিএম নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এত বড় ঝুঁকি কেন নিলেন?
অভিযোগ আছে, ভারতে যে ইভিএম ব্যবহূত হয়, তার চেয়ে ১১ গুণ অর্থ ব্যয় করে এই মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল। এর পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল? ইতোমধ্যে একাধিক সংবাদপত্রে ফলাফল নিয়ে খবর বেরিয়েছে। একাধিক ওয়ার্ডে ফল পাল্টানোর অভিযোগ উঠেছে। একাধিক সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ইসির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণের ৩১নং ওয়ার্ডের ফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ এটাই প্রমাণ করে যে, ইভিএম ব্যবহার করার পরও ফল পাল্টানো সম্ভব!
কমিশনার মাহবুব তালুকদার অভিযোগ করেছেন, তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সেই কেন্দ্রে কোনো বিএনপির এজেন্ট দেখতে পাননি। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, প্রায় সব কেন্দ্রেই বিএনপিদলীয় প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না। এর ব্যাখ্যা কী? বিএনপির প্রার্থীরা কি ইচ্ছা করেই তাদের কোনো এজেন্ট দেননি? নাকি এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি? বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ইসির উচিত এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত করা। এটা কোনো 'পরিকল্পনার' অংশ কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে, ভেতরে-বাইরে শুধুই আওয়ামী লীগ। এই তথ্যই কি প্রমাণ করে না যে, পরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্রগুলো সরকারি দলের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল? এই নির্বাচন কি প্রমাণ করে, ভোটে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে? বিএনপির সমর্থকদের কথা না হয় বাদই দিলাম; আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সংখ্যা তো কম নয়। তাহলে মাত্র ১৫-১৭ শতাংশ ভোট পড়বে কেন?
নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বিশ্নেষণ করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে! আমরা এটা স্বীকার করি আর না-ই করি, ভোট উৎসবমুখর হয়নি, যা ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া যাচ্ছে না। মোট ৪৩ কোটি ২২ লাখ টাকার নির্বাচনী ব্যয় আর এক দিনে ২২ লাখ টাকার আপ্যায়ন ব্যয় নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের প্রাপ্তি কী? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অনেক অর্জন আছে।
সেসব অর্জন যেন নষ্ট হয়ে না যায় দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর, এই প্রশ্নটাই যেন মুখ্য হয় আমাদের সবার।
Somokal
06 February 2020
Somokal
06 February 2020
0 comments:
Post a Comment