ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, ইইউ কি আদৌ তার কাঠামো ধরে রাখতে পারবে? অর্থাৎ ইইউ কি টিকে থাকতে পারবে, নাকি ভেঙে যাবে? ট্রিটি অব রোম অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে ইইউর পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি) গঠিত হয়েছিল (ইইসি ১৯৯৩ সালে ইইউ নাম ধারণ করে)।
ইইসির ইতিহাসে গ্রিনল্যান্ড হচ্ছে প্রথম দেশ, যারা ১৯৮৫ সালে সংস্থাটি ত্যাগ করে। ব্রিটেনের মতো গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের সঙ্গে মিলে ইইসিতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীন দেশ হিসেবে ওই সময় কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৭৯ সালে গ্রিনল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং একটি আলাদা পরিচিতি পায়। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেখানে গণভোটে ইইসি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৯৮৫ সালে গ্রিনল্যান্ড ইইসি ত্যাগ করে। এরপর এখন ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করল।
এখন দেখার বিষয় ইইউভুক্ত অপর ২৭টি দেশের মধ্যে আর কোনো দেশ আছে কি না, যারা ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। ইইউভুক্ত ৮টি দেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে, যারা আগামীতে ইইউ ছেড়ে দিতে পারে। এ দেশগুলো হচ্ছে ডেনমার্ক, চেক রিপাবলিক, আয়ারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি ও গ্রিস। গত দু’বছর ধরে এ দেশগুলো থেকে ইইউবিরোধী নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
এসব দেশে ইইউবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। কোথাও কোথাও তারা সরকার পর্যন্ত গঠন করেছে। রাজনৈতিকভাবে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির মতো এরা কট্টর দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী।
সিরিয়া সংকট শুরু হলে ইউরোপে ব্যাপক সিরীয় অভিবাসীর আগমন ঘটে। সেই সঙ্গে মানব চোরাকারবারির খপ্পরে পড়ে আফ্রিকা ও আফগানিস্তান থেকেও ব্যাপক শরণার্থীর আগমন ঘটে ইউরোপে, যা এক বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। এই বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর কারণে ইউরোপের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসে। কট্টর দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো এ সুযোগটি গ্রহণ করে। রাজনৈতিকভাবে তারা শক্তিশালী হয়।
শুধু স্থানীয় সরকার কিংবা পার্লামেন্ট নির্বাচনেই নয়, বরং ফ্রান্সের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী দল বিজয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। প্রথমে বড় প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল ব্রিটেনে। ট্র্যাডিশনালি ব্রিটেনে প্রচুর অভিবাসীর বসবাস। এক সময় ব্রিটেনের যেসব কলোনি ছিল, সেখান থেকে মানুষজন ব্রিটেনে বসবাস শুরু করেছিল। কিন্তু একদিকে সিরীয়-আফগান শরণার্থী, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপের (সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো) দেশ থেকে মানুষ যখন ব্রিটেনে বসবাস করতে শুরু করে, তখন জনমত এর বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে।
দাবি ওঠে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার। কিন্তু সেটি সম্ভব না হওয়ায় ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জনমত শক্তিশালী হয়। ব্রিটেনে নাইজেল ফারাজের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসেন। আর এভাবেই ব্রেক্সিটের পথ প্রশস্ত হয়।
‘ব্রিটিশ এক্সিট’ কথাটিকে সংক্ষেপে বলা হয় ব্রেক্সিট। এটা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। তবে এ কাজটি অত সহজ ছিল না। নানা প্রশ্ন ও নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘ব্রেক্সিট’ প্রক্রিয়াটি এগিয়ে গেছে।
২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রিটেনে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন ব্রিটেনের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- যুক্তরাজ্যের কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা উচিত, নাকি উচিত নয়? সেদিন ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে, আর থাকার পক্ষে ভোট পড়েছিল ৪৮ শতাংশ। এরপর ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা।
২০১০ সাল থেকে ছয় বছর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাজ্য যেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থেকে যায়। কিন্তু গণভোটে তিনি হেরে গেলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তেরেসা মে। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই (২০১৭) তিনি বলে আসছিলেন, তার সময়েই ‘ব্রেক্সিট’ সম্পন্ন হবে। কিন্তু কাজটি তার জন্য সহজ ছিল না।
ব্রিটেনের সঙ্গে ইইউর একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তিটি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যাত হলে ২০১৭ সালের জুনে আগাম সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু ভোটে কনজারভেটিভরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। পরে তেরেসা মে পদত্যাগ করলে (২০১৯) প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন।
জনসনের আনা ব্রেক্সিট প্রস্তাবও কয়েক দফা প্রত্যাখ্যাত হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এ অবস্থায় গেল বছরের শেষে সেখানে আবার নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বরিস জনসন ও তার কনজারভেটিভ পার্টি।
ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা অর্থনৈতিকভাবে ইইউকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। সেখানে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। অন্যত্র চলে যাবে ব্যবসা। ক্ষতি হবে স্থানীয় অর্থনীতির। ইতিমধ্যে অনেক বড় বড় ব্যাংক ও বীমার সদর দফতর লন্ডন থেকে সরিয়ে ফ্রাংকফুর্টে (জার্মানি) নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ব্রেক্সিটের ঘটনা আদৌ ব্রিটেনকে বিশ্ব আসরে একটি ‘শক্তি’তে পরিণত করতে পারবে না। এটা সত্য, ব্রিটেনের ভোটাররা প্রথমে গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে এবং পরে সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের বিজয়ী করে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু এতে তারা খুব লাভবান হবেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বরং ইইউতে থেকেই ব্রিটেন বিশ্ব আসরে বড় ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন তাতে ছন্দপতন ঘটল। কেমন হবে এখন ব্রিটেন, সে প্রশ্নও আসছে। ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে থাকবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
এখন ব্রিটেনকে ইইউভুক্ত প্রতিটি দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি করতে হবে। এ আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যেসব ইইউ নাগরিক বর্তমানে ব্রিটেনে কাজ করেন, তাদের ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্ত আসতে হবে। এমনকি যেসব ব্রিটিশ নাগরিক ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন, তাদের ব্যাপারেও একটি চুক্তি করতে হবে।
যুক্তরাজ্য বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর একটি। জি-৭-এর সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যও যুক্তরাজ্য। দুর্বল যুক্তরাজ্যের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না বিশ্ব আসরে। যুক্তরাজ্যের জিডিপির পরিমাণ ৩ দশমিক ০২৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এটা ক্রয়ক্ষমতা অর্থাৎ পিপিপির ভিত্তিতে হিসাব, সাধারণ হিসাবে এর পরিমাণ ২ দশমিক ৯৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বে ৫ম। মাথাপিছু আয় সাধারণ হিসাবে ৪৪ হাজার ১৭৭ ডলার (বিশ্বে ১৯তম), পিপিপিতে এর পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫৬৫ ডলার (২৫তম)। এ অবস্থান যুক্তরাজ্য ধরে রাখতে পারবে না।
আগামী এক দশকের মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি দেশ ইইউ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার এবং স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান নিকোলা স্টুরজিওন ও তার দল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চান। আয়ারল্যান্ডের সিন ফেইন পার্টিও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির সাবেক সভাপতি নর্বাট হোফারও চান অস্ট্রিয়াকে ইইউ থেকে বের করে আনতে।
বেলজিয়ামের ফ্লেমিন ন্যাশনালিস্ট পার্টি প্রধান টম ভ্যান গ্রাইকেন, ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টির ক্রিশিয়ান থালেসেন, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের ম্যারিয়েন লি পেন, জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানির ফ্রক পেট্রি, হাঙ্গেরির ফ্রিডেসজ পার্টির ভিক্টর আরবান, ইতালির ফাইভ স্টার মুভমেন্টের বেপ্পে গ্রিল্লো- এরা সবাই নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে ইইউ থেকে বের হয়ে আসতে চান। গ্রিনল্যান্ডের পথ অনুসরণ করে এখন ব্রিটেন বেরিয়ে গেল।
এরপর ব্রিটেনের পথ অন্য দেশগুলো অনুসরণ করে কি না, কিংবা অন্য দেশগুলোয় এর প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা বোঝার জন্য নিদেনপক্ষে আরও একটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রিটেনকে অনেকগুলো চুক্তি করতে হবে। এসব চুক্তির প্রতিক্রিয়া থাকবেই। এসব প্রতিক্রিয়ার ওপরই নির্ভর করবে কোন কোন দেশ ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায়।
বলতেই হয়, ব্রেক্সিট চুক্তি কার্যকর হলেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যা আগামী দিনে ব্রিটেন তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে যে ‘ডিভোর্স’ বা ‘প্রত্যাহার’ চুক্তি হয়েছে, তাতে ব্রিটেন কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দিতে হবে ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড। ব্রিটেনে ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব নাগরিক রয়েছেন, এখন তাদের কী হবে?
নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকের মাঝামাঝি ইইউ ও ব্রিটেনের সীমানা এখন কীভাবে নির্ধারিত হবে? যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড কি যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে ইইউতে যোগ দেবে? আইরিশ সীমান্তে এখন কী হবে, এটা একটা বড় চিন্তার কারণ। ব্রিটেনের সঙ্গে ইইউর যে চুক্তি হয়েছে, তাতে ‘ব্যাকস্টপ’ নামে একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্রেক্সিট সমঝোতায় যাই আসুক না কেন, আয়ারল্যান্ড দ্বীপে একটি মুক্ত সীমান্ত রাখার সর্বশেষ চেষ্টা বোঝাতে ‘ব্যাকস্টপ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটা হল এমন এক ব্যবস্থা যেখানে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশ ছাড়া শুধু নর্দান আয়ারল্যান্ডে খাদ্যদ্রব্যসহ বেশকিছু বিষয়ে ইইউর নিয়ম বলবৎ থাকবে। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক এমপি। তাদের যুক্তি- ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাচ্ছে, এটা হতে পারে না।
আবার অনেকে ইইউর কাছাকাছি বা ভেতরেও থাকতে চাইছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নর্দান আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্নভাবে দেখা উচিত নয়। এমন একটি সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে যে, স্কটল্যান্ডও এখন যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
অনেক ‘কিন্তু’ আর অনেক ‘প্রশ্ন’ নিয়ে ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে ইইউ তার যাত্রা শুরু করল। এই ইইউর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিংবা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় ইইউর ভূমিকা কেমন হবে- এসব প্রশ্ন এখন বারবার আলোচিত হতে থাকবে। তবে ভয়টা হচ্ছে এখানে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নভেম্বরের (২০২০) মার্কিন নির্বাচনে আবারও বিজয়ী হন, তাহলে ইউরোপের কট্টর দক্ষিণপন্থীরা আরও শক্তিশালী হবে। আর এতে করে ইইউর ভেঙে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে মাত্র
Jugantor
8.2.2020
0 comments:
Post a Comment