বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে পাঁচ ‘নি’-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন ইন্সটিটিউটের এক কর্মশালায় তিনি তার ওই তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। প্রথম ‘নি’ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়তা’। অর্থাৎ নির্বাচনটি সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা। এ নিশ্চয়তার অর্থ ভোটার ও রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টি। দ্বিতীয় ‘নি’ হচ্ছে- ‘নিরপেক্ষতা’।
এর অর্থ হচ্ছে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি। তৃতীয় ‘নি’ হচ্ছে- ‘নিরাপত্তা’ এই নিরাপত্তা ভোটার, রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরভাবে নির্বাচনকালে কমিশনের প্রত্যক্ষ ও তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা। চতুর্থ ‘নি’ হচ্ছে- ‘নিয়মনীতি’। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে বিধিবিধান পরিচালনার আওতায় আনা।
পঞ্চম ‘নি’ হচ্ছে- ‘নিয়ন্ত্রণ’। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা। তিনি এ কথাগুলো বলেছেন এমন এক সময় যখন ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচনটি ভালো হয়নি। মাত্র ১৭ থেকে ২০ ভাগ ভোট পেয়ে দু’জন ‘নগরপিতা’ হয়েছেন।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক সময় যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। যদিও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চার মূল্যায়ন করা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা তো পাওয়া যায়ই।
জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্টের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের অবস্থান (১৬৭ দেশের মাঝে) দেখিয়েছিল ৮০ নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছিল ‘হাইব্রিড ডেমোক্রেসি’ ক্যাটাগরিতে (ইকোনমিস্ট, ২২ জানুয়ারি ২০২০)। ‘হাইব্রিড’ অর্থাৎ অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ইনকোনমিস্ট বলতে চেয়েছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণ নয়।
মোট ৪টি ক্যাটাগরিতে বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশকে ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। যেমন Full democracies বা পূর্ণ গণতন্ত্র (৯.৮৭ পয়েন্ট নিয়ে নরওয়ে শীর্ষ), Flawed democracies বা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (৮ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে শীর্ষে), Hybrid regimes বা অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র বা সরকার ব্যবস্থা (উত্তর মেসিডোনিয়া ৫.৯৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ), আর Authoritarian regimes বা কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ব্যবস্থা (৩.৯৩ পয়েন্ট নিয়ে জর্দান রয়েছে শীর্ষে)।
বাংলাদেশের পয়েন্ট ৫.৮৮। বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রিডম হাউস ২০১৯ সালের Freedom in the World 2019-এর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘Partly Free’। এখানে তিন ক্যাটাগরিতে দেশগুলোকে ভাগ করা হয়েছে (Free, Partly Free, Not Free)। সামগ্রিক বিচারে দেশগুলো কতটুকু স্বাধীন, তা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকারি ব্যবস্থা, মিডিয়া কতটুকু স্বাধীন, আইনের শাসন কতটুকু আছে- এসব বিবেচনা করেই দেশগুলোর ‘স্বাধীনতা’ ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে। আবার Reporters Without Borders প্রকাশ করেছে ২০১৯ সালের Press Freedom Index। এতে শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে এক নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান এখানে ১৫০ নম্বরে (মেট ১৮০টি দেশ জরিপে স্থান পেয়েছে)। প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে যেখানে নরওয়ের স্কোর ৭.৮২, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৫০.৭৪ (সর্বনিম্নে অবস্থানকারী তুর্কমেনিস্তানের স্কোর ৮৫.৪৪)। বাংলাদেশের নিচে অবস্থান সিঙ্গাপুরের, অর্থাৎ সেখানে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। আবার বাংলাদেশের উপরে স্থান পেয়েছে কম্বোডিয়া (১৪৩), পাকিস্তান (১৪২), মিয়ানমার (১৩৮), উগান্ডা (১২৫)।
গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে, এটা সত্য, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা Global Gender Gap Index 2018-এর কথা উল্লেখ করতে পারি, সেখানে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান আমরা দেখি ৪৮ নম্বর (সর্বনিম্নে আছে ইয়েমেন ১৪৯ নম্বরে ও ০.৪৯৯ স্কোর নিয়ে।
সবচেয়ে ভালো অবস্থানে, অর্থাৎ ১ নম্বরে আছে আইসল্যান্ড, স্কোর ০.৮৫৮১। এখানে ৪ ক্যাটাগরিতে এ র্যাংকিং করা হয়েছে (অর্থনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ, শিক্ষা অর্জন, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন)। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেক কম, ৫ নম্বরে। আইসল্যান্ড যেখানে ১ নম্বরে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে থাকা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
আমরা আরও অনেক তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝাতে পারব। প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ঢাকার দুটো সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হলেও এর ফলাফল নিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না।
ঢাকার সিটি নির্বাচন হয়েছিল। এ নির্বাচনের প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এটি অংশিদারিত্বমূলক হয়েছে। অর্থাৎ বড় দলগুলো সবাই অংশগ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ‘রাজপথের বিরোধী দল’ বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। খুন-খারাবির ঘটনাও তেমন ঘটেনি। তৃতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বড় দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পেরেছে।
কোনো ধরনের বাধা দেয়া হয়নি। চতুর্থ প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে নির্বাচনের পর বিএনপি কোনো সহিংস রাজনীতি উসকে দেয়নি। কিন্তু মাইনাস পয়েন্ট বোধকরি অনেক। ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটা বিতর্ক বাড়িয়েছে। অনেক ভোটার ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে অন্যরা ভোট দিয়েছেন, এমন খবর কাগজে ছাপা হয়েছে। গোপন কক্ষে সরকারি দলের কর্মীদের দেখা গেছে, তারা ভোটারদের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কিংবা নিজেরাই ভোটারদের আঙুলের ছাপ নৌকা মার্কায় ‘পুশ’ করেছেন- এসব পত্রিকার খবর।
খোদ সিইসির এনআইডি ইভিএম মেশিন শনাক্ত করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয় যে, শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত না হয়ে ইসি ইভিএম মেশিন ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি কেন নিল? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইভিএম মেশিন ব্যবহার নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনে বিভক্তি ছিল।
মাহবুব তালুকদারের আপত্তির কথা আমরা সবাই জানি। অপর একজন কমিশনারও বলেছিলেন, ‘ভোট কেন্দ্র দখলে থাকলে’ ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব! সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছিল কিছুদিন আগে, ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব কিনা, তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ওই কমিটিতে থেকেও তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তিনি স্বাক্ষর করেননি।
একজন সাংবাদিক এ তথ্যটি টিভি সংলাপে দিয়েছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইভিএম নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এত বড় ঝুঁকি কেন নিলেন? অভিযোগ আছে ভারতের যে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে ১১ গুণ অর্থ ব্যয় করে এ মেশিনগুলো কেনা হয়েছে। এ অভিযোগের পেছনে যদি কোনো সত্যতা থাকে, তা আমাদের চিন্তার কারণ। দুদক অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে।
ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলো আরও ৬টি নির্বাচনের খবর। একটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন, অপর ৫টি উপনির্বাচন। আগামী ২১ মার্চ ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ এবং ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, বগুড়া-১ ও যশোর-৬ এর উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হবে।
ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির আপত্তি ও ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পরও বিএনপি এ ৬টি নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। প্রার্থীদেরও বিএনপি চূড়ান্ত করেছে এবং সংবাদমাধ্যমে তা জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু এ ‘অংশগ্রহণ’ কি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে? পাঠক, স্মরণ করতে পারেন- সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৪ ফেব্রুয়ারি)। ভোটকেন্দ্রে মানুষের অনুপিস্থিতির কথা বোঝাতে গিয়েই তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন।
আর তখন মাহবুব তালুকদার ৫ ‘নি’ তত্ত্ব দিলেন। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার- শুধু অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। নির্বাচনের সুষ্ঠুতার সঙ্গে জড়িত নিরপেক্ষতা, নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি, নিরাপত্তা এবং নির্বাচন কমিশনের ‘ভূমিকা’। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় এ সবের অনুপস্থিতির কারণেই মানুষ এখন আর ভোট কেন্দ্রে যায় না। কিন্তু ভোট হয়।
এবং এক একটি নির্বাচনের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় (ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৩ কোটি ২২ লাখ টাকা)। এ টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকা। এত পিুল অর্থ ব্যয় করেও কেন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা যায় না- তা খুঁজে বের করা দরকার। নির্বাচন কমিশন তার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মাহবুব তালুকদার ওই নির্বাচন কমিশনেরই অংশ।
এখন তিনি পাঁচ ‘নি’ তত্ত্ব দিলেন। সংকটটা হচ্ছে মার্চে অনুষ্ঠেয় ৬টি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি? তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার বাকি সহকর্মীরা তা সমর্থন করেন কি? নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচন হবে, তাতে করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চাকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব কি? একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নটিই আমার কাছে এই মুহূর্তে মুখ্য।
Jugantor
22.2.2020
If you're trying hard to burn fat then you absolutely have to start using this brand new custom keto diet.
ReplyDeleteTo design this keto diet, certified nutritionists, fitness couches, and professional cooks united to develop keto meal plans that are powerful, suitable, money-efficient, and delightful.
Since their first launch in 2019, thousands of clients have already remodeled their body and well-being with the benefits a proper keto diet can provide.
Speaking of benefits: in this link, you'll discover eight scientifically-tested ones provided by the keto diet.