advertisementআদালতের পরিচালক ফাকিসো মোকোচোকো গত ৪ ফেব্রæয়ারি বলেছেন, তারা যে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার সুবিচার নিশ্চিত করা। রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে গত নভেম্বর মাস থেকে তাদের তদন্তকাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান। ফাকিসো মোকোচোকো এমন এক সময় ঢাকায় এসে এ কথাগুলো বললেন, যখন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার ব্যাপারে একটি রায় দিয়েছে। কিন্তু ওই রায়টি ঘোষিত হওয়ার পরও মিয়ানমারের রাখাইনে আবারও হত্যাকাÐ হয়েছে। একই সঙ্গে দৈনিক আমাদের সময়ে একটি সংবাদও ছাপা হয়েছে গত ৪ ফেব্রæয়ারি, যেখানে বলা হয়েছে স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে গেলেও নিজ বাড়ি-ঘরে যেতে পারেনি তারা। এর অর্থ পরিষ্কার। মিয়ানমার আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশ মানছে না। আইসিজে যে অন্তর্বর্তী আদেশ দেন, তার মাঝে রয়েছে : ১. গণহত্যাসহ সব নিপীড়ন থেকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়া, ২. রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সামরিক, আধাসামরিক অথবা এজাতীয় কোনো সংস্থা এমন কোনো ব্যবস্থা বা কাজ করবে না যাতে মিয়ানমারের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে; ৩. গণহত্যার কোনো আলামত নষ্ট না করা; ৪. মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি ৪ মাস অন্তর অন্তর আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে পেশ করতে হবে। আইসিজের এই অন্তর্বর্তী রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। মিয়ানমার এই আদেশ মানতে বাধ্য। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। মিয়ানমার এখন কী করবে? নিঃসন্দেহে এই রায় মিয়ানমারের বিপক্ষে গেছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে একটি বিশেষ সুরক্ষার অধিকারী গোষ্ঠী, তা প্রমাণিত হলো। এই আদেশ মানতে মিয়ানমার বাধ্য। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যে নিজ বাসভ‚মে ফেরত যাবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আইসিজে এ ধরনের কোনো আদেশ দিতে পারে না। এটা অং সান সুচি জানেন ও বোঝেন। তাই এই রায়টিকে তিনি ও তার সরকার এবং সেনাবাহিনী খুব গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয়ত, সু চি ভালো করে জানেন যে, তার পেছনে চীন আছে। চীন অতীতে প্রতিটি সংকটে, বিশেষ করে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে এবং আগামীতেও করবে। তাই আইসিজের রায় নিয়ে তার কোনো উৎকণ্ঠা নেই।
গত ১৮ জানুয়ারি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মিয়ানমার সফর শেষ করেছেন। গত ১৯ বছরের মধ্যে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের জন্য এটা ছিল প্রথম মিয়ানমার সফর। একাধিক কারণে ওই সফরের গুরুত্ব রয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার ব্যাপারে সারাবিশ্ব যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং আইসিজেতে একটি রায়ের জন্য যখন সবাই অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই চীনা প্রেসিডেন্ট মিয়ানমার সফর করলেন। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রতি চীনা সমর্থন আবারও শক্ত হয়েছিল এবং বিশ্ব আসরে মিয়ানমারের পাশে যে চীন থাকবে, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো। ওই সফরে মিয়ানমার ও চীন ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার মধ্য দিয়ে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। চীন রাখাইনে কিয়াউকপিউ (কুধঁশঢ়ুঁ) গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চীনা জাহাজের প্রবেশাধিকার ও নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে। একই সঙ্গে ১২১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কিয়াউকপিউ-কুনমিং রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ ব্যাপারেও একটি চুক্তি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইউনান রাজ্যের পণ্য কিয়াউকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা সহজ হবে। এটা মিয়ানমার-চীন অর্থনৈতিক করিডরের অংশ। এক সময় এই করিডরের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত ছিল, যা বিসিআইএম করিডর নামে পরিচিত ছিল (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার)। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ও ভারতকে বাদ দিয়েই চীন মিয়ানমারকে সম্পৃক্ত করে এই অর্থনৈতিক করিডরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। বিসিআইএম করিডরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কক্সবাজারের সমুদ্র উপক‚লে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। চীন এই বন্দরটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে সেই পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়। ফলে চীন বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে রাখাইনের কিয়াউকপিউতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে এবং সেখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তুলছে চীন।
চীন যে ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার একটা বড় অংশ হচ্ছে বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ হবে রাখাইনে, যেখান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সারাবিশ্ব যেখানে বলছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে এবং কফি আনান কমিশনের যেখানে সুপারিশ ছিল রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভ‚মে তাদের নিজের বসতভিটায় পুনর্বাসন করতে হবে, সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করে গেলেন, যাতে ওই রোহিঙ্গা বসতিতেই কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। ফলে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভ‚মে ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে সৃষ্টি হলো বড় ধরনের অনিশ্চয়তার। তারা আর তাদের নিজ বাসভ‚মে ফিরতে পারছেন না। গেল নভেম্বরে (২০১৯) আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে মামলা (গাম্বিয়া কর্তৃক) হয়েছিল এখন তার রায় হলো। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি নিজে দি হেগে মামলা পরিচালনা করেছিলেন। সেখানে তিনি মিথ্যাচার করেছিলেন। সারাবিশ্ব যেখানে রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে, সেখানে তিনি আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। বিশ্ববাসীর ধারণা ছিল যেহেতু তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, ফলে তিনি ‘সত্যটা’ স্বীকার করে আদালতকে জানাবেন যে, তিনি তার জনগোষ্ঠীকে ফেরত নেবেন। কিন্তু বিশ্ব অভিমতকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি সেখানে প্রকারান্তরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এ ধরনের একটি রায় আসবে। এই রায় তাকে ক্ষমতায় থাকতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। তাই তিনি বিশ্বজনমতের বিপক্ষেই গিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, মিয়ানমারের ওপর আস্থা না রাখার আরেকটি কারণ হচ্ছে অং সান সু চি ও মিয়ানমারের রাজনৈতিক কাঠামো। এই রাজনৈতিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি রোহিঙ্গাবিরোধী। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে একটি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বিকাশ লাভ করেছে। এরা কট্টরপন্থি থেরাভাদা (ঞযবৎধাধফধ) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এরা কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত। ধর্মগুরুদের প্রতি এদের আস্থা ও বিশ্বাস অনেক বেশি। এরা সংস্কারে বিশ্বাসী নয়। এদের প্রচুর অনুসারী মিয়ানমারে। এই থেরাভাদা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মিয়ানমারকে বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। অনেক সিরিয়াস পাঠক আমিন ভিরাথুর কথা মনে করতে পারেন। তাকে নিয়ে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন কভার স্টোরি করেছিল ২০১৩ সালের ১ জুলাই। কভার স্টোরির শিরোনাম ছিল ‘দি ফেস অব বুদ্দিস্ট টেরর’। তিনি প্রচÐ রকম মুসলমানবিদ্বেষী। এজন্য তাকে ‘মিয়ানমারের লাদেন’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তিনি মিয়ানমারে তরুণ বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের সংগঠিত করে মুসলমানবিদ্বেষী একটা সেন্টিমেন্ট গড়ে তুলেছিলেন। এই সেন্টিমেন্টকে সু চি ধারণ করেন। অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু সু চি এই মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সু চির বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে তার বাবা আউং সানের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আউং সান ছিলেন তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতাকামী নেতা, ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বার্মার প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিকভাবে আউং সান প্রথমদিকে ছিলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী। পরবর্তীকালে তিনি পরিচিত ছিলেন মডারেট ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেট’ হিসেবে। এই আউং সানের সন্তান হিসেবে সু চি কীভাবে এখন কট্টর বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হলেন, সেটাই অবাক করার বিষয়। এর পেছনে কাজ করছে তার সুবিধাবাদী রাজনীতি। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে খুশি রাখতে চান, যারা থেরাভাদা বৌদ্ধধর্মকে ‘প্রমোট’ করছে এবং সু চি মনে করছেন সেনাবাহিনীকে হাতে রেখেই তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসবেন (চলতি বছর সেখানে সাধারণ নির্বাচন)। একই সঙ্গে কট্টরপন্থিদের সমর্থন দিয়ে তিনি মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রেও পরিণত করতে চান। এখানে মিয়ানমারের রাজনীতি মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবই হলো তার কাছে প্রধান অগ্রাধিকার। তার জন্য একটা সুযোগ ছিল মিয়ানমারে দীর্ঘস্থায়ী একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু তিনি তা করলেন না। নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতিও তিনি কোনো সম্মান দেখালেন না।
ইতোমধ্যে মিয়ানমার সরকারিভাবে আইসিজের রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে আমি অবাক হইনি। মিয়ানমার এ রকমই একটি রাষ্ট্র। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, অতীতে মিয়ানমার জাতিসংঘ থেকে একবার নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তাই ধারণা করছি আইসিজের রায়ের পরও মিয়ানমারের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। এই রায়ের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মান দেখাবে, এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই। যতদিন পর্যন্ত না মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যায়, ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না এবং তাদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করবে না। একটা রায় হয়েছে বটে। তাতে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই
Amader Somoy
8.2,2020
0 comments:
Post a Comment